বেঁচে থাকার অপর নাম জীবন। আর সেই জীবন রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন আর মৃত্যু এখন খুব কাছাকাছি। সেটাই অবলোকন করছে বিশ্ববাসী। গণমাধ্যম খুললেই মৃত্যুর খবর। সোস্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন, অনলাইন, ই-পেপারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে আর বাড়ছে। মৃত্যুর এ মিছিল কবে থামবে জানি না। ইতিমধ্যেই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তের এক লাখেরও বেশি মানুষ। এসময় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণ’ কবিতার এই উক্তিগুলোর মর্মার্থ বুঝতে শুরু করেছি।
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই!’
কঠিন এসময়ে ফ্রন্টলাইনে বীরযোদ্ধার জীবন বেছে নিয়েছেন চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, জরুরি সেবাকর্মী, নিরাপত্তা কর্মীসহ আরও অনেক পেশার মানুষ। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। জীবনবাজি রেখে এর মধ্যেই জরুরি পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছেন ওইসব পেশার মানুষ। করোনার রোগীদের চিকিৎসা ও পরিষেবা দিতে গিয়েই আত্মাহুতি দিয়েছেন অনেকে। অনেক স্বেচ্ছাসেবকও বেছে নিয়েছেন এ জীবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন তৈরি পর্যন্ত লকডাউন রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখনো পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাননি বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রাণঘাতী ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কারে লড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত রোগটির প্রাদুর্ভাব রোধে লকডাউন ব্যবস্থা পুরোপুরি তুলে নেওয়া উচিত হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন গবেষকরা। চিকিৎসাবিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল দ্য ল্যানসেটে এক প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে গবেষকরা এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন বলে খবর দিয়েছে সিএনএন।
ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সহগবেষক হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ টি য়ু বলেছেন, লকডাউনের মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করোনার সংক্রমণ নিন্মপর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তবে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের মতো শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে সেটি আবারও ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। লকডাউন তুলে নিলে ব্যবসাবাণিজ্য চালু হবে, কল-কারখানা খুলবে, স্কুল-কলেজগুলো চালু হবে। এভাবে মানুষের মেলামেশা বাড়বে, সামাজিক যোগাযোগ বাড়বে, তাতে ফের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বাড়বে বলেও গবেষক জানান। জোসেফ টি য়ু বলেনম ‘পুরো বিশ্বে এখনই ভাইরাসটির সংক্রমণ বন্ধ হয়নি। তাতে অন্য কোনো দেশ থেকে ফের চীনেই এ রোগ ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন দেশ যদি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে নীতি না মানে তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নেয় এবং জোরালোভাবে করোনার সংক্রমণ তদারকি না করে তবে এ ভাইরাস ফের ছড়িয়ে পড়বে।
তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে চালু করাই উপযুক্ত কৌশল বলে জানিয়ে দিয়েছেন গবেষণা সহকারী।
দুই.
ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতা, ধনী-গরিব, আমির-ফকির কাওকেই ছাড় দিচ্ছে না করোনা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়েছেন। জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যে একজন প্রধানমন্ত্রীর এভাবে আইসিইউতে স্থানান্তর হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও করেন্টাইন কাটিয়ে এখন কাজে ফিরেছেন।
পৃথিবীর অনেক দরিদ্র দেশে এখনো এ ভাইরাসটির প্রকোপ দেখা যায়নি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি। পৃথিবীর দুইশটিরও বেশি দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে এ সংকট মোকেলায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে পিছিয়ে পড়া হতো দরিদ্র দেশগুলোতে এ ভাইরাস মোকাবলা কীভাবে করবে এটিই এখন চিন্তার উদ্রেক করছে! চলতি সময়ে ভাইরাসটির কারণে থমকে গেছে পুরো পৃথিবী। বদলে দিয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে ভয়ংকর করোনা ভাইরাসে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল চীনের উহান শহর। দীর্ঘদিন লকডাউনে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। উহানকে পুরো চীনের অন্যান্য শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার কারণে তিন মাস আট দিন পর করোনার উৎপত্তিস্থল উহান উৎসব নগরীতে পরিনত হয়েছে। সবকিছুই উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। করোনা জয়ের সফলতায় পুরো উহান শহরকে আলোকসজ্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সারাবিশ্বে করোনা ছড়িয়ে দিয়ে উহানবাসী উৎসব করছেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন। উহানবাসী আনন্দ করছে আর সারা বিশ্ব লড়ছে করোনার ভাইরাসের বিরুদ্ধে। করোনা জয় করে এখন সারা বিশ্বে করোনার কীট বাণিজ্য করছে চীন। অর্থনীতির দ্বিতীয় শক্তিশালী চায়নার সামনে প্রথম হওয়ার হাতছানি। স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে বিশ্বকে কাবু করে ছেড়েছে উহানে অবস্থিত পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়োলজিক্যাল ল্যাব। সন্দেহ করা হয়, ওই ল্যাব থেকেই করোনা ভাইরাস লোকালয়ে চলে আসে।
তিন.
গত কয়দিন আগে চীন করোনাভাইরাসে মৃত্যুহীন একটি দিন পার করেছে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে ঘরে বন্দিদশায় ছিল চীনের উহানের মানুষ। গত বুধবার তাদের বন্দী জীবনের অবসান হয়েছে। চায়না কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন তুলে নিয়েছে। উহানের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ। গত ২৩ জানুয়ারি এ শহর লকডাউন করা হয়। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ শহরের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। সেখানে মৃত্যুবরণ করেছে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মরে যাওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই উহানের। চীন এর উহান যেমন আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশও করোনা মুক্ত হতে পারবে এ আত্মবিশ্বাস সবার আছে।
স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কোনো একটি কর্ম পন্থা বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো কৌশল এখনো নির্ধারণ করা হয়নি সত্য। তবে দেশে দেশে লকডাউন চললেও আশার আলো তৈরি করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। জাপানে করোনার ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরাও সাফল্যের কাছাকাছি বলেও শোনা যাচ্ছে। করোনার উৎপত্তি যে চীনে সেখানেও করোনা মুক্ত ঘোষণা দিয়ে লকডাউন খুলে দিয়েছে। সেই চীনই এখন আশার আলো দেখাচ্ছে।
জাপানে যাদের বয়স কম তাদের জন্য আভিগান প্রয়োগে রোগী সাত দিনে সুস্থ হয়ে যায় এবং পিসিআর ফলাফল নেগেটিভ আসছে। এটা জাপানের ১২০ জন রোগীর উপর প্রয়োগের ফলাফল। যারা মধ্যময়সী তাদের জন্য আভিগান এবং ওরভেসকো দুটোর মিলিত ফলাফল ৯ দিনে সুস্থ। তবে আভিগান প্রেগন্যানট মহিলাদের জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। অবশ্য চীন আভিগান নিয়ে পজিটিভ ফলাফল আগেই ঘোষণা করেছে। জাপান’সহ বর্তমান আরও ২০টি দেশে আভিগান এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছেন। আশার কথা খুব শিগগিরই আভিগান এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যেই আভিগান তৈরির জন্য প্রস্তুত।
এদিকে, চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জনসাধারণের জন্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। এমনটাই জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শারাহ গিল্ডবার্ট। টিকা আবিষ্কারে বিশ্বের দেশে দেশে চলছে গবেষনা। অনেক দেশ এগিয়েও গেছে অনেক দূর।
আশা জাগানিয়া এসব খবর দেখে মনে হচ্ছে আলো আসবেই। সূর্য উঠবেই! ততদিন পর্যন্ত না হয় ঘরে লকডাউন এ থেকে নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে ও বিশ্বকে রক্ষা করি।