বরং সেই ভালো মুখ বন্ধ রেখে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি!

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের আওতাধীন সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীকে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে জনসম্মুখে, সংবাদপত্রে অথবা অন্য কোন গণমাধ্যমের সাথে কোন রকম আলোচনা, বিবৃতি বা মতামত প্রদান না করার নির্দেশ দেয়া হলো- গত ১৫ তারিখে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ এটি।

এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। গত শনিবার একাত্তর টেলিভিশনের এক প্রতিবেদন উঠে আসে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্সদের চরম অসহায়ত্বের চিত্র। করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধা‌রিত কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে খাবার সংকটে পড়েছেন সেখা‌নে কর্তব্যরত নার্সরা। খেয়ে না খে‌য়ে কো‌নরকম দিন কাট‌ছে তা‌দের। কয়েকজন নার্স এমন মানবেতর সংকটের অভিযোগ করেছেন একাত্তর টেলিভিশনকে।

সম্পর্কিত খবর

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন নার্সিং ইন্সটিটিউটের উপপরিচালক শাহানারা খাতুন। তি‌নি বলেন, বাজেট না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করেছি। তারা বলেছে, অনেক মানুষ তাই সমস্যা হচ্ছে। কাল রাতেও পচা খাবার দিয়েছে। অনেক মেয়েরা না খেয়ে থেকেছে। একাত্তর টিভির এই নিউজ প্রচারের পর পুরো তোলপাড়। ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। সমালোচনার ঝড় ওঠে। কর্তৃপক্ষ বেশ চাপে পড়ে। সামনের দিনে তাদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির খবর কেউ যেন জানতে না পারে তাই এই চিঠিটা ইস্যু করা হয়। মুখ বন্ধ রাখতেই এই পদক্ষেপ।

স্বাস্থ্য সচিবের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসাপাতালের মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন ডা. আবু তাহেরকে শোকজ করা হয়েছে। শনিবার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চলতি দায়িত্বে থাকা ডা. ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ শোকজ বা কৈফিয়ত তলব করা হয় এবং আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

প্রশাসনের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেওয়ায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিকদের ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ অব্যাহত থাকায় ডিসি-এসপিসহ জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় আল মামুন নামে এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে।

গত বুধবার রাতে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বালিয়াডাঙ্গী থানার ওসি হাবিবুল হক প্রধান। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে, আসামিকে গ্রেফতার করা হবে।

এসআই মো. জহুরুল ইসলাম মামলার এজহারে উল্লেখ করেন, ‘আল মামুন ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রশাসনকে হেয় করেছে এবং কটাক্ষ করেছে। প্রশাসনের মানহানি করা হয়েছে, যার ফলে সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে পারে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে।’

এ বিষয়ে সাংবাদিক আল মামুন বলেন, লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে গাড়িতে করে মানুষ ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে এভাবে শ্রমিকদের ফেরা না ঠেকাতে পেরেই ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথম ৩ জন করোনা রোগী ধরা পড়ে। স্বাস্থ্যবিভাগ ও প্রশাসন থেকেই স্বীকার করা হয় যে এরা সবাই নারায়ণগঞ্জ ফেরত শ্রমিক। এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেই আমি স্ট্যাটাস দেই। সত্য কথা বলতে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

এর আগে গত ২৪ মার্চ তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে এক আদেশ জারি করে। আদেশে বলা হয় দেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে অপপ্রচার ও গুজব বন্ধে ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ মনিটরিং করা হচ্ছে। এ কাজের (তদারকি) জন্য ১৫ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কোন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে করোনাভাইরাস সম্পর্কে অপপ্রচার কিংবা গুজব প্রচার হচ্ছে বলে চিহ্নিত করলে, তা বন্ধ করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রনালয়ের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) মো. মিজান উল আলম বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ও অপপ্রচার বন্ধে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে মনিটরিং করার জন্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত তারা এ কাজ চালিয়ে যাবেন। প্রত্যেক কর্মকর্তা দু’টি করে টেলিভিশন চ্যানেল মনিটরিং করবেন।

আদেশে আরও বলা হয়, গত (২৪ মার্চ) কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) সংক্রমণ প্রতিহতকরণের প্রচার-প্রচারণার সংক্রান্ত কমিটির প্রথম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণের বিষয়ে অপপ্রচার গুজব প্রচার করা হচ্ছে কি-না তা মনিটরিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

তীব্র প্রতিবাদের মুখে ২৬ মার্চ এই আদেশটি বাতিল করে নতুন আরেকটি আদেশ জারি করা হয়। আগের আদেশটি বাতিল করতে নতুন আদেশ জারি করা হয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের টিভি শাখা-২ থেকে। অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) মো. মিজান-উল-আলমের সই করা এই আদেশে বলা হয়, অপপ্রচার-গুজব মনিটরিং করার জন্য জারি করা পত্রে ভুলভ্রান্তি থাকায় তা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাতিল করা হলো।

অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? বিপদে তথ্য থেকে পাওয়া জ্ঞানের আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে তথ্য প্রদানকারীকেই আপদ মনে করা হচ্ছে! ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘ডোন্ট শ্যুট দ্য মেসেঞ্জার’ (বার্তাবাহককে গুলি করো না।) অর্থাৎ বার্তা যেমনই হোক তাকে গুরুত্ব দাও, অশুভ বার্তা বলে দূত বা বাহকের গলা কেটো না।

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দিলে হয়ত ভ্রান্তিকে ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে পাওয়া যায় না। আকরিক ধাতু যেমন মটির সাথে মিশে থাকে, মাটি পরিস্কার করে তাকে পেতে হয়, জীবনের পথেও তেমনি সত্য ও মিথ্যা মিলে আছে। জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এজন্য কাঙ্ক্ষিত হিরন্ময় সত্য উদ্ঘাটনে বাস্তবের কঠিন ও দুর্গম পথে প্রয়োজন নিঃশঙ্ক দীপ্ত পদচারণা।

একটা অসম যুদ্ধ চলছে।এক অদেখা ভাইরাস বনাম গোটা পৃথিবী। গত ১৫ তারিখে করোনার কাছে হার মেনে চলে গেলেন ডা. মঈন উদ্দীন। মৃত্যুর পর উনার জন্য রাষ্ট্রীয় শোকবার্তা মিললো; পরিবারের দায়িত্ব নিলো রাষ্ট্র। কিন্তু বেঁচে থাকতে তার জন্য একটা এ্যাম্বুলেন্সও জোটেনি !

ডা. মঈন নিজের জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন করোনা সন্দেহে থাকা রোগীদের। কিন্তু ডাক্তার মঈন নিজে যখন করোনা আক্রান্ত হলেন কেন যথাসময়ে যথাযোগ্য চিকিৎসা পেলেন না? কেন সিলেট থেকে ঢাকায় আসার জন্য একটি এ্যাম্বুলেন্স পেতে জনে জনে অনুরোধ করেও পেলেন না? কেন তখন কেউ সাড়া দেয়নি?

কেন বিভাগীয় শহর সিলেটের এত বড় ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়নি? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন তখন কোথায় ছিল? রাষ্ট্রের অবহেলা, সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের এমন বলি আর কত?

আরেকটা প্রশ্ন- স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে হাত দিলে সেই কর্মকর্তাদের বদলি হতে হয় কেন? গত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেলো? এদেশের এত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এত এত হাসপাতাল এগুলোর বেহাল দশা কেন? জানি এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। উত্তর চাইতে যাওয়াও মানা।

একবার হাসান বসরী (রা:-কে জিজ্ঞাসা করা হল, আবু সায়ীদ! বলুন, আমাদের কী করা উচিত? আমরা কি এমন লোকদের সাথে বসবো, যারা এত ভয়ের কথা বলে যে, আমাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়?

তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম! যারা তোমাকে ভয় দেখিয়ে সবধান করে, যার কারণে তুমি (ঐ ভীতিকর বিপদ থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করবে এবং) মুক্তি পেয়ে যাবে-তাদের সাথে থাকাই তোমার জন্য কল্যাণকর ঐ সকল লোকদের সাথে থাকার চেয়ে, যারা তোমাকে আশ্বস্ত করতে থাকে (ফলে তুমি বিপদ সম্পর্কে উদাসীন হবে এবং) পরিশেষে ঐ ভীতিকর বিপদের শিকার হয়ে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দশ হাতে সব সামলাচ্ছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য শেখ হাসিনার পালসকে বোঝার বা ধারণ করার মত কেউ নেই। না সরকারে, না দলে। সবাই শেখ হাসিনার সামনে বলেন- সব ঠিক আছে,আমরা দেখছি। আর জনগণকে বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব দেখছেন।

সর্বত্রই কেমন যেন একটা লুকোছাপা! এই সমন্বয়হীনতা আর দায়িত্বহীনতা ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়ে আমাদের দাঁড় করাবে এই মুহূর্তে সেটা ঠিক আমার জানা নেই। তারচেয়ে বরং সেই ভালো মুখ বন্ধ রেখে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি !

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন