চিকিৎসকরা কেন স্বাস্থ্য সচিব হবেন না?

আশ্চর্য শিরোনামটি এসেছে একটি দৈনিকে, ‘মাস্ক-ল্যাব চাইলেন চিকিৎসক, অবাক হলেন প্রধানমন্ত্রী’।

যদিও প্রধানমন্ত্রীর আশ্চর্য হওয়ার বিষয়টিও যথেষ্টই আশ্চর্যের; কেননা শুরুতে মাত্র একটি, তারপর দুই ধাপে সব মিলিয়ে যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়, তার মাঝে নারায়ণগঞ্জ নেই। অধিকাংশ উপদ্রুত অঞ্চলেই যে নেই, তাও উদ্বিগ্ন দেশবাসী ভালোমতোই জানেন। দেশবাসী ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে বরং খেয়াল করেছেন সিলেটের মতো বিভাগীয় শহরের ডা. মঈন উদ্দীনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে। তবে অভাবের খতিয়ান আজকের লেখার বিষয় না, বিষয় এই না থাকা এবং বহুক্ষেত্রে থাকা সম্পদের অপচয়ে, সমন্বয়হীনতায়, পরিকল্পনাহীনতায় আমলাতন্ত্রের দায় কতখানি, সেটা।

২. নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভী বহু আগে থেকে লকডাউন করার দাবি করেছেন। কলকারখানা মালিকদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বহু দেরিতে তা করা হলো, নারায়ণগঞ্জ ততক্ষণে দেশজুড়ে করোনার উৎসভূমি হিসেবে নাম কুড়িয়েছে। সম্ভবত আস্থা ফেরাতেই নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসকদের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সের আয়োজন। লক্ষণীয়, কারো মধ্যস্থতা ছাড়া চিকিৎসক সরাসরি বক্তব্য দেয়ার সুযোগটা পেয়েই তিনি যেহেতু মোসাহেব সাংবাদিক নন, স্বার্থপর সুদক্ষ আমলাও নন, সোজাসুজি বলে ফেলেছেন যে মাস্ক নেই, পরীক্ষাগার নেই। এর কারণ চিকিৎসক হিসেবে তাকে ঘটনার মাঝেই থাকতে হয়। রোগীর যন্ত্রণা তিনি দেখেন, নিজেও ওই ঝুঁকিতেই বসবাস করেন।

এই যে নতুন বেশ কয়েকটি গবেষণাগারে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, কীভাবে তা রাতারাতি সম্ভব হচ্ছে? আমদানি করে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে প্রশিক্ষিত জনবল ও অবকাঠামো আগে থেকেই ছিল, বহুলাংশে যন্ত্রপাতিও। সেগুলো প্রস্তুত করা হয়নি, ব্যবহারও করা হয়নি, এমনকি ভাবাও হয়নি। শুধু বারবার ঘোষণা করা হয়েছে—আমরা প্রস্তুত। তাহলে তিন মাসের বিরাট সময়টা স্বাস্থ্য বিভাগ কী কাজে ব্যয় করেছে, তার গুরুতর একটা তদন্ত হওয়া উচিত না?

৩. বাংলাদেশে করোনার পুরো দুর্যোগটাকেই সামাল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে আমলাতান্ত্রিক পথে এবং বিষয়টা যদি এমন হয় যে দেশের স্বাস্থ্য খাত দেখবে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, তার পরিকল্পনা, ব্যয় বরাদ্দ, গুরুত্ব নির্ধারণ ইত্যাদি করবে যারা, তাদের কর্মকর্তাদের মাঝে যদি এমন একজন বিশেষজ্ঞও না থাকেন, যিনি একজন পেশাদার চিকিৎসক, যিনি দেশের অনেকগুলো হাসপাতালে কাজ করেছেন, যার ধারণা আছে দেশের প্রস্তুতি ও অপ্রস্তুতি সম্পর্কে, যিনি একটা মহামারীর তাত্পর্য, গভীরতা ও বিপদ অনুমান করতে পারেন, তাহলে যা হওয়ার কথা, ঠিক তা-ই হয়েছে বাংলাদেশে।

শুধু চিকিৎসকের মৃত্যু ও সংক্রমণ নয়, কোটি কোটি মানুষের বহুবিধ দুর্দশাও ডেকে এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপ্রস্তুতি ও গাফিলতি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চতম সব পদে যে চিকিত্সা এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরই যে প্রধানত থাকা উচিত (চিকিত্সা-নৃবিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জীবাণুতত্ত্ববিদ, পরিসংখ্যানবিদ ইত্যাদি), সেটা এত ক্ষয়ক্ষতির পরও আমরা শিখতে পারলাম কি?

করোনার ঘোর দুর্যোগ এভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি ভয়াবহ দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। প্রশ্নটা বহু পুরনো, কিন্তু নতুনভাবে এটা তোলার দরকার আছে: কেন বিশেষায়িত ব্যক্তিরা তাদের নিজ নিজ পেশার শীর্ষতম প্রশাসনিক পদগুলোয় নিযুক্ত হবেন না? শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিত্সা সব পেশা সম্পর্কেই এ কথাটি প্রযোজ্য।

সংকটকালেই শুধু নয়, পৃথিবীজুড়েই বিশেষজ্ঞরাই স্বাভাবিক অবস্থায়ও এ পদগুলো অধিকার করে থাকেন, অসফল রাষ্ট্রগুলোতেই কেবল এ নিয়ে তর্ক চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের যোগ্যতা কী হওয়া উচিত? আমার মতে, অনেকগুলো বড় হাসপাতালে ও জেলায় জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব পালন যিনি করেছেন, সব জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সব মানুষকে যিনি চেনেন, প্রাপ্য জনবল সম্পর্কে যার ধারণা আছে, সংশ্লিষ্ট গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগুলো তার উপলব্ধির মাঝে আছে, মুহূর্তের মাঝে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যিনি যোগাযোগ করতে এবং তাদের ভাষা বুঝতে পারেন এবং সর্বোপরি একটা মহামারীর অগ্র-পশ্চাৎ যিনি হূদয়ঙ্গম করতে পারেন, যেকোনো নতুন সংকটে যথাদ্রুত প্রস্তুতির জন্য জনস্বাস্থ্যের বিষয়টাকে অনেক গভীরভাবে দেখার শিক্ষাগত সামর্থ্য যার আছে এবং সর্বোপরি যিনি কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নন। এর মানে এই নয় যে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের একরৈখিকতার জন্য কোনো সমস্যা হবে না। এমন একটা মানুষও হয়তো ভুল করবেন, কিন্তু নিশ্চিত থাকুন কখনই এতটা লেজেগোবড়ে হবে না, যেখানে আপনার যা যা সম্পদ ও জনবল আছে, সেটাই সক্রিয় করতেও তিন মাস যথেষ্ট হয় না।

সর্ববিদ্যা বিশারদ একজন আমলার ব্যক্তিগত গুণাবলি যতই ভালো হোক না কেন, কারো পক্ষেই তো সব বিষয়ের খুঁটিনাটি জানা অসম্ভব, চিকিত্সার মতো চরম বিশেষায়িত পেশায় তো তা বলাই বাহুল্য। ফলে কোন খাতে বরাদ্দের ধরন কেমন হওয়া উচিত, কোনটির অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, কখন লকডাউন করতে হবে, তা বাইরের কেউ সুবিবেচনার সঙ্গে করতে পারবেন না। স্বাস্থ্য সচিব যদি পেশাদার চিকিৎসক হন, যার স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও আছে, তাহলেই সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। সর্বক্ষণ তিনি নিচের সারির এবং নিজের পেশার লোকদের চাপে থাকবেন ভালো কিছু করার জন্য। অন্যদিকে দুই বছরের জন্য আসা কেউ হয়তো সৎ ভাবনা থেকেই একটা দামি রক্তশোধন যন্ত্র কেনার ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু সেটা চালাতে একজন প্রযুক্তিবিদও যে লাগবে, তা তার ভাবনাতেই হয়তো থাকবে না।

৪. আমলাতান্ত্রিকতার বিপদগুলো দেখুন। বরাদ্দের প্রায় পুরোটুকুই জবাবদিহিতাহীনভাবে আমলাতন্ত্র তার খেয়াল অনুযায়ী ব্যবহার করে। কল্পনাতীত অর্থ ব্যয় করে যন্ত্রপাতি হাসপাতালগুলোর নামে কেনা হয়। এতে দুর্নীতি যা-ই হোক, অপচয় আরো বেশি হয়। পিসিআর মেশিন আছে, টেকনিশিয়ান নেই, এ ঘটনা অজস্র। এমনকি ডা. মঈনের বেলায়, সিলেটের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ভেন্টিলেটর যন্ত্র থাকলেও (তার মান নিয়ে গণমাধ্যমে সংশয় প্রকাশ করেছেন সেখানকার সিভিল সার্জনও), তার অপারেটর নিয়োগ হয়নি। এভাবে জীবনর অপচয় চলছে, সম্পদের অপচয় চলছে আমলাতন্ত্র কবলিত স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষিসহ সব বিশেষায়িত বিভাগে।

কিন্তু এর চেয়ে বড় সমস্যা আসলে এই যে সংশ্লিষ্ট পেশার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিটি একটা পর্যায়ের পর পদোন্নতির জন্য আর বিবেচিত হন না। সচিবের পদগুলোয় আসেন প্রশাসনের ব্যক্তিরা। পেশাজীবীর হতাশা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এভাবে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোয় বিশেষজ্ঞ আর সিদ্ধান্তদাতাদের মাঝে একটা অনতিক্রম্য ফারাক; সব নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন ধরাছোঁয়ার বাইরের আমলাতন্ত্র। এভাবে ধ্বংস হয় সব জবাবদিহিতা, অন্যদিকে সিদ্ধান্তগুলো যারা নিচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা প্রায়ই অনবহিত।

প্রকৌশলবিদ্যা কিংবা সাহিত্য, যেখান থেকেই আসুন না কেন, আমলার প্রধান কাজ হবে ঊর্ধ্বতনকে বুঝ দেয়া, আড়াল করা, অন্যদের দাবিয়ে রাখা। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষজ্ঞদের ক্ষমতায়ন তার স্বার্থের সঙ্গে একদমই যায় না। একেকটা বিভাগে কয়দিনের জন্য এসেছেন, কয়দিন পর চলেও যাবেন, ফলে এই ক্ষণস্থায়ী কর্মস্থলের স্থায়ী উন্নতি বিধানে তার মনস্তাত্ত্বিক আগ্রহও ব্যতিক্রম ছাড়া থাকার কথা নয়। বহুক্ষেত্রে আসলে তিনি হয়তো বিষয়টা বোঝেনই না। সবচেয়ে বড় কথা, তার নিজের আনুগত্য, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি এবং জবাবদিহিতা যেখানে নিহিত, সংগত কারণেই আনুগত্য ও ভালোবাসাও নিজের সেই একমেবাঅদ্বিতীয়ম ক্যাডারটির প্রতিই থাকে।

৫. এই কথাটি কি অগ্রহণযোগ্য যে একটা মহামারীর পরিস্থিতিতে প্রতিটি জেলার সিভিল সার্জনের প্রধান কর্মকর্তা হয়ে ওঠার কথা এবং তার পরামর্শ অনুযায়ীই কৃষকরা কীভাবে ধান কাটতে পারেন, বিশেষ কোনো কারখানা খোলা রাখতেই হলে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, রাস্তায় চলাচল কীভাবে করতে হবে, হাটবাজারের নিয়ম কী হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ের নীতিনির্ধারণ করার কথা? এই সিভিল সার্জনও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকেই জাতীয় পর্যায়ের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবেন। জেলার বাকি সব পদাধিকারী মিলে একটা সামগ্রিক কর্মকৌশল ঠিক করে তারপর তা বাস্তবায়নে প্রশাসন, পুলিশ, পরিবহন, কৃষিসহ সবার কাজ করার কথা নয় কি? একইভাবে কৃষির একটা দুর্যোগে চিত্রটা হবে আরেক রকম। অথচ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি সবার চেয়ে এক প্রশাসনের কর্তারা বেশি বিদেশ ভ্রমণ করে ফেলেন কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণে কিংবা পুকুর খনন পরিদর্শনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যেসব চিকিৎসক নিয়োগ পান, তারাও ভালো করেই জানেন আমলাতন্ত্রের হাতে তারা কতখানি জিম্মি। ফলে তারা হয় সহ্য করেন অথবা নিজেরাও এই অনিয়মের ভাগীদার হন।

আমলাতন্ত্রই যদি সবার কাজ কেড়ে নেয়া শুরু করে, যা হওয়ার কথা, সেটাই বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এদিক দিয়েও আমরা তুলনাহীন, বাংলাদেশ আজকে এমন একটা দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে, যেখানে একটি রাজনৈতিক খোলস সামনে হাজির রেখে প্রশাসন পুরো দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। গিলেছে বটে, কিন্তু হজম ভালো হচ্ছে না, তাদের অযোগ্যতা করোনার আলোড়নে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

অজস্র চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ করোনা মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে তিন মাস ধরে লিখেছেন। তিন মাস আগেই আসত মাস্ক, প্রয়োজনে মাস্ক, পিপিইর কারখানা বসত দেশে, যদি নিজ পেশার বিশেষজ্ঞ কেউ থাকতেন স্বাস্থ্য সচিব। এ দাবিটি তাদের একদা ছিল, ভুলে গেছেন তারা, দেশের এই দুর্গতির দিনে স্বাস্থ্যসেবার এই নীতিনির্ধারক জায়গায় সংস্কারের দাবিটি আবার কি তুলবেন না তারা?

ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও রাজনৈতিক সংগঠক

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন