করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর উপসর্গ নিয়ে দেশের ১৪ জেলায় এক শিশুসহ আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবার মৃত্যু হয়েছে গত শুক্রবার ও শনিবার। এর মধ্যে একজন আছেন যিনি করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নওগাঁয় মারা যাওয়া নারী ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন। আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপকূলে পণ্যবাহী একটি ট্রলারে। ফরিদপুরে একজনকে রাস্তার পাশ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন। জ্বর, সর্দি ও ডায়রিয়া নিয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের শেফালী গ্রামে এক নির্মাণ শ্রমিক শনিবার সকালে মারা যান। মৃতদের কারও কারও নমুনা করোনা পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। মৃত ও প্রতিবেশীদের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গোয়াল গ্রামের কারিগরপাড়ায় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন এক ব্যক্তি (৩০)। তিনি পেশায় ছিলেন দিনমজুর। এলাকার লোকজন জানায়, ওই ব্যক্তি কয়েক দিন ধরে জ্বর, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের জন্য স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাঁর আগে থেকে হাঁপানির সমস্যা ছিল বলে স্বজনরা জানায়। দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার জানান, করোনা উপসর্গ থাকায় মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির (৫৫) মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ দিন ধরে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও পাতলা পায়খানা নিয়ে তিনি প্রথমে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর নমুনা নেওয়া হয়। পরে ভোলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে শুক্রবার তিনি মারা যান। ওই দিন রাত ১১টার দিকে তাঁকে গোপনে দাফন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এলাকার লোকজন জেনে যায়। এরপর খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন কাশ্মির গ্রাম, উত্তর গজারিয়া গুচ্ছগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড লকডাউন করে।
ভোলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী মাহবুবুর রহমান জানান, মারা যাওয়া ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার নবীয়াবাদের এক ব্যক্তি (৫৫) গত শুক্রবার সকালে মারা গেছেন। জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেন ও দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আহমেদ কবির সাংবাদিকদের জানান, ওই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জে চাকরি করতেন। জেলাটি লকডাউন করার আগে তিনি নবীয়াবাদে চলে আসেন। এরপর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৪ এপ্রিল পাশের চান্দিনা উপজেলা বাজারের একজন চিকিৎসকের কাছে যান। ৬ এপ্রিল তিনি দেবীদ্বারের মেডিক্যাল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. হাবিবের চিকিৎসা নেন। ৯ এপ্রিল সকালে দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মীরা তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠান। ৯ এপ্রিল রাতে তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। শুক্রবার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও কুমিল্লা জেলার সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী জানান, তাঁরা মৃত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যে অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাঁকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় এবং ঢাকায় নেওয়া হয়, সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপমুখী মালবাহী ট্রলার এমভি কর্ণফুলীতে গত শুক্রবার গভীর রাতে এক খালাসির মৃত্যু হয়েছে। সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকায় তাঁর বাড়ি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম পনির জানান, হাতিয়া উপকূলে ট্রলারে থাকা অবস্থায় জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত কারণে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ট্রলারের সারেং বিকাশ জানান, ট্রলারটি চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় লবণ নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাঁরা সন্দ্বীপে ফিরছিলেন। ট্রলারে থাকা আরেকজনও জ্বরে আক্রান্ত।
সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম জানান, আইইডিসিআরের গাইডলাইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিকে সন্দ্বীপে দাফন করা হবে। তাঁর নমুনা ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে পাঠানো হবে। ট্রলারে থাকা অন্যদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যাথা ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত এক দিনমজুরের (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই ব্যক্তি তাঁর নিজ বাড়িতে মারা যান। ওই দিনমজুরের বাড়ি পাশের উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের নগরহাওলা গ্রামে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম ফতেহ আকরাম জানান, ওই রাতেই তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে তাঁর সংস্পর্শে থাকা স্ত্রী, ছেলে ও বোনের নমুনা সংগ্রহ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। ইউএনও শেখ শামছুল আরেফীন জানান, মৃত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা স্বজনদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মাদারীপুরের কালকিনির রমজানপুর ইউনিয়নের চড়াইলকান্দি গ্রামে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক নারী (৪৫) গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা গেছেন। কালকিনি উপজেলা প্রশাসন তাঁর বাড়ি লকডাউন করেছে। গতকাল সকালে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আল-বিধান মোহাম্মদ সানাউল্লাহ জানান, ওই নারীর নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার কাউতলীতে শনিবার সকালে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক নারীর (৩৫) মৃত্যু হয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মৃত ওই নারীর করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মারা গেছেন এক বৃদ্ধা। গতকাল দুপুরে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসে ওই নারী মারা যান।
এদিকে ওই নারীকে খাজানগর গ্রামের কবরস্থানে দাফন করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দেয়। তাদের হামলায় মো. ফারুক হোসেন নামে নবীনগর থানার এক পুলিশ কনস্টেবল আহত হন। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক নারী শনিবার মারা গেছেন। তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। তাঁর নমুনাসহ মোট ১০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ জানিয়েছেন।
খুলনায় জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত ছয় মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (মেডিসিন) ও করোনা ইউনিটের ফোকাল পারসন ডা. শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, শিশুটি জ্বর, সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তার করোনা সংক্রমণ ছিল কি না, তা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় জ্বরে আক্রান্ত এক ব্যক্তি (৪৮) মারা গেছেন। তিনি ঝিনাইদহের খাজুরা সিটি কলেজ এলাকার বাসিন্দা। এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই ব্যক্তি পেশায় একজন দিনমজুর। তিনি মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের মাঝিবাড়ী এলাকার ইদ্রিস মিয়ার বাড়িতে কাজ করতেন। পাঁচ-ছয় দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হলে গত বৃহস্পতিবার তাঁকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন ইদ্রিস। শুক্রবার সকালে তিনি একটি রিকাশা ভ্যানে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার পথে একটি জুটমিলের কাছে ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়কের পাশে একটি গর্তের ধারে তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায় ভ্যানচালক। সারা দিন সেখানেই পড়ে ছিলেন তিনি। করোনা সন্দেহে কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। পরে মধুখালীর ইউএনও মোস্তফা মানোয়ার ও থানার ওসি আমিনুর রহমান গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মো. জুয়েল জানান, রাত পৌনে ১১টার দিকে ওই রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়; কিন্তু তার আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন। শনিবার মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে খোলা মাঠের এক পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টের কারণেই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত ব্যক্তির বাড়ি উপজেলার মাঘান-সিয়াধার ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামে। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সুবির সরকার বলেন, ‘শনিবার সকাল ১০টার দিকে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে আক্রান্ত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন তাঁর এক আত্মীয়। পরে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণগুলো দেখে আমাদের মনে সন্দেহ হয় এবং আমরা তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়াসহ তাঁর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করি। কিন্তু তাঁর স্বজনরা তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহে না গিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে মাঠের এক কোনায় ফেলে রেখে চলে যান এবং বিকেলে অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টে সেখানেই তিনি মারা যান। পরে খবর পেয়ে সন্ধ্যায় তাঁর অন্য স্বজনরা এসে মরদেহ গ্রামে নিয়ে যান।’ ডা. সুবির আরো বলেন, মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে রাখা নমুনা পরীক্ষার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ফেনীর পরশুরাম এলাকায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। সে স্থানীয় একটি মাদরাসার আলিম (এইচএসসি) শ্রেণির ছাত্র ছিল। শনিবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবদুল খালেক বলেন, শনিবার হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তার দেহ থেকে করোনার সংক্রমণ জানতে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি।