শিল্প-কারখানা, ব্যাংক শেয়ারবাজার লকডাউনে খোলা থাকছে

আগামীকাল থেকে সারা দেশে সপ্তাহব্যাপী লকডাউন শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল দুই মন্ত্রী। তবে এ সময়সীমায় পরে পরিবর্তন আসতে পারে। সেক্ষেত্রে তা নির্ভর করবে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর। লকডাউন চলাকালে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর বন্ধ রাখা হবে। একই সঙ্গে বন্ধ থাকবে রেল, নৌ ও আকাশপথে অভ্যন্তরীণ চলাচল। এর বিপরীতে চালু থাকবে হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো জরুরি সেবা। খোলা থাকবে শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমনকি শেয়ারবাজারও।

এখনো লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে তা আজই জারি হতে পারে। গতকাল এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, করোনার বিরাজমান পরিস্থিতিতে সরকার সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে শিল্প-কারখানা শর্তসাপেক্ষে চালু থাকতে পারে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকার এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখনো অনেকেই মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে।

একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও। লকডাউন প্রসঙ্গে গতকাল এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, দ্রুত বেড়ে যাওয়া করোনার সংক্রমণ রোধের স্বার্থে সরকার দু-তিনদিনের মধ্যেই সারা দেশে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, যা আপাতত এক সপ্তাহের জন্য। লকডাউন চলাকালে যারা শুধু জরুরি সেবা দেয়, সে ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে। আর শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে। তবে শ্রমিকদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শিফটিংয়ের মাধ্যমে কলকারখানায় কাজ করতে হবে।

সরকারের দুই দায়িত্বশীল মন্ত্রীর লকডাউন সংক্রান্ত বার্তার পর গতকাল বিকালে এক জরুরি বৈঠক ডাকেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং সচিব উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া লকডাউন বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থা ও দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও সভায় অংশ নেন। বৈঠকে লকডাউনের সময়সীমা ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া চালু থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের কর্মপদ্ধতি ও যাতায়াতের বিষয়েও কথা হয়েছে। বৈঠকে চূড়ান্তকৃত প্রস্তাবগুলো প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী, লকডাউন চলাকালে রেল ও নৌ যোগাযোগ এবং অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরকারের লকডাউন ঘোষণায় যেহেতু গণপরিবহন বন্ধের কথা বলা আছে, তাই যাত্রীবাহী রেলসেবা বন্ধ থাকবে। তবে সরকার চাইলে পণ্যবাহী রেলসেবা চালু থাকবে। সরকার যদি লকডাউন আরো বাড়িয়ে দেয় তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) গতকাল সন্ধ্যায় লকডাউন চললে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান এ প্রসঙ্গে গতকাল জানান, যেহেতু সারা দেশে এক সপ্তাহ লকডাউন থাকবে, এজন্য অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট চলাচলও বন্ধ থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচল করবে। সরকারের লকডাউন-সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে এটি করা হয়েছে। তবে এখনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করার পর বেবিচকও প্রজ্ঞাপন জারি করবে।

এদিকে গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যাংক সেবা সীমিত করে এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিস্থিতির বিচারে দফায় দফায় এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কর্মীদের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের মাধ্যমে জনবল কমিয়ে আনা, নিকটবর্তী এলাকায় একটি শাখা খোলা রেখে অন্যগুলো বন্ধ রাখাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংক সেবা চালু রাখা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন। আজ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

অন্যদিকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন কার্যকরের ঘোষণা আসার পর পুঁজিবাজার চালু থাকবে নাকি বন্ধ হয়ে যাবে, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে শঙ্কা দেখা দেয়। তবে এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু থাকলে পুঁজিবাজারও চালু থাকবে।

গতকাল ডিএসইর চেয়ারম্যান মো. ইউনুসূর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে ব্যাংক চালু থাকলে পুঁজিবাজারও চালু থাকবে। লকডাউনের সময় ডিজিটাল মাধ্যমে পুঁজিবাজারের লেনদেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে গতকাল সন্ধ্যায় জরুরি পর্ষদ সভা করে ডিএসই।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গতকালের সভায় লকডাউন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত পুঁজিবাজারে লেনদেন চলবে। তবে সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর আগে ১৫ মিনিটের প্রি-ওপেনিং সেশন থাকছে না। অবশ্য বেলা ২টায় নিয়মিত লেনদেন শেষে আগের মতোই যথারীতি ১৫ মিনিটের পোস্ট ক্লোজিং সেশন চালু থাকবে।

উল্লেখ্য, এক বছর ধরেই কভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা। মহামারীর এ সময়ে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, সে অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। ফলে লকডাউন শুরু হলে এ অভিজ্ঞতা কাজে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে ডিএসইর ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারের লেনদেন আরো আগে থেকেই ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে। কভিড-১৯-এর কারণে এক বছর ধরেই ব্রোকারেজ হাউজগুলো যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। এক্ষেত্রে এক বছরে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে লকডাউনের সময় তা আমাদের জন্য সহায়ক হবে।

নীতিগতভাবে ব্যাংক চালু থাকলে পুঁজিবাজারের লেনদেনও চালু রাখার পক্ষে বিএসইসি। তবে লকডাউন নিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার ভিত্তিতে পুঁজিবাজারেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কমিশন।জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, শেয়ার কেনাবেচার অর্থ নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু থাকা আবশ্যক। তাই ব্যাংক চালু থাকলে পুঁজিবাজারও চালু থাকবে।

ব্রোকারেজ হাউজগুলো সীমিত সংখ্যক কর্মীর মাধ্যমে তাদের ওয়ার্ক স্টেশন চালু রাখতে পারবে। আর বিনিয়োগকারীরা ফোনে, ই-মেইলের মাধ্যমে কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে বাড়িতে বসেই শেয়ার লেনদেন করতে পারবেন। তাই লকডাউনের সময় পুঁজিবাজার চালু রাখা নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। তবে লকডাউনের বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন এবং ব্যাংকিং লেনদেন-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে যদি প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারির বিষয়টি বিবেচনা করবে কমিশন।

এর আগে করোনা সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ সরকার জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস ও কারখানা অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা করা, জনসমাগম সীমিত করা, পরিবহনের ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনাসংবলিত প্রজ্ঞাপন জারি করে।

প্রসঙ্গত, দেশে করোনা সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। আর করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। এরপর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা পরে কয়েক দফা বাড়ানো হয়।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন