ছেলেটার মানুষ হওয়ার আর কোন আশা রহিল না

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবসঞ্চারী লেখক, জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে যে মাত্রা দান করেছেন, তা অতুলনীয়। ছোটবেলা থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি অমুখাপেক্ষী ছিলেন তিনি। পরিবার চাইতো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করুক কিন্তু তিনি বরাবরের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাকে পাঠানো হলো বিলেতে(১৯১৭) কিন্তু তাকে ফিরতে হলো খালি হাতে। বুঝতেই পারছেন কার কথা বলা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন মা সরস্বতীর বরপুত্র অমৃত কণ্ঠস্বর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে,১৮৬১ খ্রি.-৭ আগস্ট, ১৯৪১)।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এই ছেলেটিই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘বনফুল’নামক এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিলো তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ ছিলো তার। ত্রিশের দশকের কবিরা যখন রবীন্দ্রনাথকে তিনি যথেষ্ট আধুনিক নন এই অভিযোগে অভিযুক্ত করলো তখন তিনি তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন ‘শেষের কবিতা'(১৯২৯)।জীবনের অন্তিম সময়ে এসে এমন একটি উপন্যাস রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অমর উপন্যাস হিসেবে আজও পাঠক সমাজে সমাদৃত। সেই সময়ে তিনি এ উপন্যাসে যেভাবে তথাকথিত আধুনিকতা আর আটপৌরে জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, তা আজকের যুগেও আমাদের অনেকের চিন্তার পরিধির বাহিরে।

সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচরণ নেই।গান,ছোট গল্প, উপন্যাস, কাব্য, নাটক-সব ধরণের রচনাতেই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯১৩ সালে তার’ গীতাঞ্জলীর’ ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা সংকলন ‘Song offerings’-(১৯১২)এর জন্য। এ কাব্যে ১৫৭ টি কবিতা রয়েছে। এর ভূমিকা লেখেন W.B Yeats।এশীয়দের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভাগ্যবান।শুধু ‘গীতাঞ্জলী ‘কেন ‘বলাকা,চিত্রা,মানসী,সোনার তরী,ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ প্রত্যেকটি পৃথক পৃথকভাবে বিচার করলে প্রতিটিতেই তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্য।

কাব্যের কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি তার ছোটগল্পের কথা বলি তাহলে বলতে হয়, একজন বিশ্বমানের ছোটগল্পকার তিনি। বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ মাত্র ১১৯ টি ছোটগল্পে যে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন তা সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয়। বাংলা ছোটগল্প তার হাত ধরেই বিকাশ লাভ করেছে। তার কাবুলিওয়ালা, পোস্ট মাস্টার, সমাপ্তি, শাস্তি, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, সুভা, অপরিচিতা, স্ত্রীর পত্র, ছুটি, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি ছোটগল্প শিল্পের মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী।

বাংলা উপন্যাসের ও নিজের পাকাপোক্ত আসন তৈরি করে রেখেছেন তিনি। যে ভিত কেউ কোনদিন ভাঙতে পারবে না। মাত্র ১২ টি উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর। “চোখের বালি, গোরা,ঘরে বাইরে,নৌকাডুবি, যোগাযোগ, বৌ ঠাকুরানীর হাট,চতুরঙ্গ, দুই বোন” ইত্যাদি প্রত্যেকটি উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন মানবিকতার জয়গান। ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের রচয়িতাও তিনি। তার প্রতিটি উপন্যাসেই রয়েছে মানবিকতা।

আমাদের দুঃখ আর বিরহের সময় একমাত্র সান্ত্বনা রবীন্দ্র সঙ্গীত। পৃথিবীর সবকিছুই পুরাতন হয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান যেন পুরাতন হয় না,সবসময় নতুনের বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এর সুর,লয়,ছন্দ সবসময়েই প্রশংসার দাবি রাখে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের মধ্যেই আমরা পাই এক অনাবিল প্রশান্তি। এ প্রতিভাবান মানুষটি একসঙ্গে তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা ও তিনি।

যোগ্য ব্যক্তিরা কীর্তিকে কখনো বিশ্বাস করে না,তেমনটিই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, “কালের তরঙ্গে এসব ধুয়ে মুছে যাবে “। মানুষকেই সবসময় সত্য হিসেবে জেনেছেন তিনি।বিশ্বাস করতেন মানুষকে। তাই তো তিনি বলেন,” মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। “

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। চেয়েছেন সবসময় হিন্দু মুসলমানের মিলন। তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে এ বিষয়টি স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ সরকার যখন ১৯১৫ সালে তাকে ‘নাইট’ উপাধি দেয় ১৯১৯ সালে জালিওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন। নিষ্ঠুর ইংরেজ শাসকদের গুলিতে প্রাণ হারানো জাতীয় বীরদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই তার এ প্রতিবাদ।

ইংরেজি সাহিত্যে যে রকম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, রুশ সাহিত্যে যেরকম লিও তলস্তয়, জার্মান সাহিত্যে গ্যাটে, ফ্রেঞ্চ সাহিত্যে ভিক্টর হুগো, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে গর্সিয়া মার্কুয়েজ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ঠিক একই রকমভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো ২০০৪ সালে বিবিসির করা এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে সেরা তিনে স্থান পেয়েছেন।তাকে ‘বিশ্বকবি ‘অভিধায় প্রথম অভিষিক্ত করেন পণ্ডিত রোমান ক্যাথলিক ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কিছু উদ্ধৃতি:-
√কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই। (জীবিত ও মৃত)
√এ যে দুর্লভ,এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।(হৈমন্তী)
√কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে কি পাও।
√মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
√যেখানে ফ্রি থিংকিং নেই সেখানে কালচার নেই।
√গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
√সমস্ত শরীরকে বঞ্চিত করে কেবল মুখে রক্ত জমলে তাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন