করোনাকালেও ‘আনফিট’ শ্রমিকরাই ঢাল, ভিআইপিরাই ‘ফিট’

কয়েকমাস আগে পেঁয়াজের দাম যখন অবিশ্বাস্য রকম বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন নাম না জানা এক রিকশাচালকের মন্তব্য ছিল- ‘সবকিছুরই দাম বাড়ে, খালি মানষের (মানুষের) দাম বাড়ে না, নিত্যিদিন (নিত্যদিন) কমে। আগে অন্তত  পাঁচ বছর পর পর হলেও হালকা-পাতলা দামদুম পাইতাম- এখন তাও নাই’। এই চরম রাজনৈতিক উপলব্ধি আসতে তার বিশেষ কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার হয়নি।

তখনো দেশে করোনার আবির্ভাব ঘটেনি। তখনো মানুষ চায়ের দোকানে আড্ডা দিতো, ‘কোনোমতে কায়দা করে টিকে থাকা’র গল্প করতো। সেই গল্প-আড্ডাও এখন আর হয় না হয়তো তাদের। হাহাকার, অনাহার, অনিশ্চয়তা, অসহায়ত্ব এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কায়দা করে টিকে থাকাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সেই গল্পও ফুরিয়ে গেছে তাদের। করোনাপূর্ব কালেও এইসব প্রান্তিক খেটে-খাওয়া, ‘দিন আনে দিন খায়’ প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষগুলো প্রান্তেই ছিল। ‘কেন্দ্র থেকে দেখা’ চিত্রে তারা চিত্রিত হতো ক্ষুদ্রকায় জীব হিসেবেই। যাদের শরীরটাই সম্বল, টিকে থাকার কায়দাই যাদের একমাত্র ‘অ্যাক্রোবেটিক জ্ঞান’। এইসব শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষগুলো যা কিছু ‘সম্বল’ সেগুলোর ওপর ভর করেই চলে ‘ভিআইপিগিরি’। ‘গ্রামের পাড়া থেকে শহরের মহল্লা’, সব জায়গাতেই বিভিন্ন স্তরের ‘ভিআইপি’ তাদের ‘ভিআইপিগিরি’ চালান। তাদের পুষ্ট করে ওইসব প্রান্তিক মানুষ। করোনাপূর্ব কালেও স্বাস্থ্যখাতে এই ‘ভিআইপিগিরি’ প্রকট মাত্রায় দৃশ্যমান ছিল, যা করোনাকালে এসে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

একটা কথা তো সত্য যে, করোনা র‌্যাংক বোঝে না, ‘বিত্ত-শ্রেণি-জাত-পাত-বর্ণ-লিংগ-ভাষা-ধর্ম’ বোঝে না। করোনা একটা জীবন্ত ধারকের সন্ধান করে, পেয়ে গেলে গেঁড়ে বসে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, একটা পর্যায়ে ধারককে পরাস্ত করে। কিন্তু সেই করোনাকেও বেগ পেতে হচ্ছে ‘ভিআইপি বলয়’ ভেদ করতে। সামাজিক দূরত্ব (আসলে শারীরিক দূরত্ব), বার বার সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, করোনা প্রতিরোধী মাস্ক (ডিসপোজেবল) ব্যবহার করা, জীবাণুনাশক ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন ও মিনারেলস যুক্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ইত্যাদি করোনা প্রতিরোধের কার্যকর উপায়। আমাদের এই দেশে কোন পদের ও কত শতাংশ মানুষ তা পারবে? বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে ৪৪ লক্ষ শ্রমিক যুক্ত আছেন। তারা কী পরিবেশে কাজ করেন, কী পরিবেশে থাকেন, কী খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন? হাজার হাজার শ্রমিক স্রোতের মতো ধেয়ে যায় কারখানা অভিমুখে, দেখতে মনে হয় পিঁপড়ার সারি যেনো অন্নের সন্ধানে জড়াজড়ি করে যাচ্ছে- দেশের শ্রমিক অঞ্চলগুলোর সকাল আর সন্ধ্যার চিত্র এমনই। কেন্দ্র থেকে ক্যামেরার চোখে দেখে বুঝদার ব্যক্তিবর্গ বলেন, ‘দেখো দেখো- দেশের অর্থনীতি হেঁটে যায়’! সারাবিশ্বে ৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা ঘুম আর বাকি ৮ ঘণ্টা ‘যা খুশি তাই’- এটাই স্বীকৃত। তবে আমাদের শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের টাকায় ‘পরের দিন কাজের শক্তি অর্জনের’ মতো খাবার হয় না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে ওভারটাইম করে। কারখানা মালিকরাও ‘শ্রমিকরা ইচ্ছে করে ওভারটাইম করে’ বলে ইচ্ছেমতো কাজ করায়। শুধু তাই নয়- আগে শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অনুমতি সাপেক্ষে ২ ঘণ্টা ওভারটাইম করানো বৈধ ছিল। এখন শ্রম আইনের সেই ধারাকে অব্যাহতি প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়, এর ফলে শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকেই ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করাতে পারার ক্ষমতা পেয়েছে গার্মেন্ট মালিকরা। যা আইএলওসহ সকল আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। যখন তখন চাকরি হারানোর ভয়, মজুরির অনিশ্চয়তার কথা বাদই দিলাম।

তারপর শ্রমিকদের আবাসনের কথাই ধরুন- বাল্ক বেডের (দ্বিতল বিছানা) নাম আমরা জানি। আমাদের অনেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে খাটের উপরে ও খাটের নিচে মেজেতে ঘুমায়। ওই একই রুমে তাদের খাওয়ার ঘর, কায়দা করে টাকা জমিয়ে একটা টেলিভিশন কিনে তারা ওই ঘরকেই ড্রয়িং রুম হিসেবেও ব্যবহার করে এবং ওই একই ঘরেই তার বাচ্চাটা নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টাও করে। কয়েকমাস আগে ‘বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি’র একটা গবেষণায় উঠে এসেছিল- মাসের বেশিরভাগ দিনই শ্রমিকরা আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি খায়, মাসে একদিন হয়তো ব্রয়লার মুরগী। গরুর মাংসের জন্য তাদের বেশিরভাগেরই অপেক্ষা করতে হয় কোরবানির ঈদের জন্য। ফলমূল বলতে তারা তেমন কিছু চিনতে পারে না। এই অবস্থায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো করোনার আগমন।

এই করোনাকালেও দেখা গেলো একদেশে দুই নীতি। সামাজিক দূরত্ব বজায়ের জন্য দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা, কিন্তু গার্মেন্ট মালিকদের ক্ষমতা দেয়া হলো- প্রয়োজন মনে করলে কারখানা খোলা রাখার। যেন এরা ৪৪ লক্ষ শ্রমিকের জন্য ‘বিশেষায়িত সরকার’। মালিকরা শ্রমিকদের একবার বাড়িতে পাঠালেন, তারপর আবার আনলেন, তারপর আবার পাঠালেন এবং তারপর আবার আনলেন। ১৬ মে পর্যন্ত জাতীয় ছুটি বাড়নো হলেও শ্রমিকদের জন্য ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। কেন সরকার ও মালিক এটা করতে পারলো? কারণ সোজা- ‘ভিআইপিগিরি’ রক্ষা করতে অর্থ লাগবে, লাগবে মুনাফা। শ্রমিকরাই মুনাফার সৃষ্টিকর্তা। ‘না খেয়ে মরা’ আর ‘করোনায় মরা’- এই দুই বিকল্পই শ্রমিকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে আমাদের ‘ভিআইপি তন্ত্র’। এতো বড়, বিশাল মুনাফার গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের ৩ মাস কাজ ছাড়া খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখেন না, সেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সরকার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পরও দেখা গেলো বেতনের দাবিতে দেশের সকল শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে করোনাকালেও পেটের দায়ে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। এখনো সকল শ্রমিক তাদের বেতন পাননি, অনেকে চাকরিও হারিয়েছেন।

করোনা প্রতিরোধের জন্য প্রতিরোধমূলক সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও যেমন ভিআইপিগিরির দাপুটে দখল আছে, তেমনি দখল তাদের আক্রান্ত হওয়ার পরের ধাপেও। বিপরীতভাবে শ্রমিকদের না আছে প্রতিরোধমূলক সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষমতা, না আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সামর্থ্য।  তেমননি আক্রান্ত হবার পরেও আমাদের শ্রমিকদের ‘সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করা’ ছাড়া অন্য কোন কিছু করার তেমন সুযোগ নেই। করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও আছে বড় ভিআইপি, ছোট ভিআইপির লবিং। কার টেস্ট আগে হবে, কারটা হবে পরে- এই ধাক্কাধাক্কিতেও তেমন পেরে ওঠেন না আমাদের শ্রমিকরা, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও। এর পরবর্তী ধাপে হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রেও আছে চরম ভিআইপিগিরি। তারপর অক্সিজেন, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর…! সকলধাপেই শ্রমিকরা প্রান্তিক হিসেবে প্রান্তেই থাকেন।

করোনা সারাবিশ্বেই একটা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এই আসন্ন মন্দা মোকাবেলাতেও আবারো প্রথম সারির পদাতিক বাহিনীর ঢালের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের। সবার আগে খুলে দেয়া হয়েছে পোশাক কারখানা। যেন তারাই তথাকথিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’র প্রথম গিনিপিগ। যদিও সম্প্রতি মন্ত্রীরা বলেছেন, কোনো কারখানায় আক্রান্ত বেশি হলে সেই কারখানা বন্ধ করা হবে, শ্রমিকদের জন্য আলাদা আইসোলেশন সেন্টার করার কথা তারা বলেছেন। শুনে মনে হয় তারা ‘দেখি না কী হয়’ নীতি নিয়েছেন, এবং শ্রমিকদের ওপর সেই নীতি প্রয়োগ করছেন। ইতিমধ্যেই শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সাভারের সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কারখানার খুলে দেয়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারণ তো পরিষ্কার- অর্থনৈতিক চাকা ঘোরাতে আমাদের শ্রমিকদেরকেই প্রথম ধাক্কাটা দিতে হবে। যে অর্থনীতি চুইয়ে পড়ে শ্রমিকের ভাগ্য না খুললেও, খুলে যাবে ভিআইপিদের ভাগ্য। খুলে যাবে আরো আরো নব্য ভিআইপি সৃষ্টির দ্বার। শ্রমিকের ঘামের টাকায় বেড়ে যাবে বিদেশের ‘বেগমপাড়া’গুলোর জনসংখ্যা, বেড়ে যাবে ‘সেকেন্ড হোম’এর সংখ্যা।

শ্রমিকরা যেন শুধু শ্রম দেয়ার জন্য ‘ফিট’, আর বাকি সবকিছুতেই তারা প্রায় ‘আনফিট’। নাগরিক অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই। শুধু একটা উদাহরণ দেই- প্রায় সব অফিস-আদালত যখন ছুটি, তখন শ্রমিকরা কিন্তু কারখানায়। জাতীয় ছুটি তো সবারই পাওনা ছিল! তা তারা পুরোপুরি পাননি। তাদের বেতন পাওয়ার কথা ছিল, তারা ৬০ শতাংশ পেয়েছেন, অনেকে কিছুই পাননি বরং হয়েছেন ছাঁটাই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই ‘জাতীয় ছুটি’ পাওয়ার, পূর্ণ বেতন পাওয়ার জন্যও তারা ফিট না।

এই করোনাকালেও ডারউইনের ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ থিওরিমতে ভিআইপিরাই ‘ফিটেস্ট’। তারা এন-৯৫ মাস্ক পরতে পারে, তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে, তারা ভিটামিন-মিনারেলস যুক্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে, তারা অ্যালকোহল বেজড হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারে। ভিআইপিতন্ত্রের ভিআইপিরা আক্রান্ত হলেও চিন্তা নাই। তারা বড় বড় হাসপাতাল পায়, আইসিইউ বেড পায়, অক্সিজেন-ভেন্টিলেটর পায়। ফলে করোনাকালেও তারাই ফিট। আর বিপরীতভাবে সবচেয়ে আনফিট হলো- আমাদের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। ওগুলোর ধারেকাছে যাওয়া তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব, তাদের দৌড় বড়জোর সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকা পর্যন্ত। ভিআইপিগিরির বাংলাদেশে ভিআইপিরা নিজেদের ফিট রাখতেই শ্রমিকদের আনফিট করে রাখার ব্যবস্থা জারি রাখে।

‘একা বাঁচা যায় না, একা নিরাপদ থাকা যায় না’- করোনাকালের এই শিক্ষা আমাদের ভিআইপি-মালিকরা নিবেন কিনা জানি না। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষকে যদি শুধু ‘মুনাফা তৈরির মেশিন’ হিসেবে ভাবা পরিত্যাগ না করেন তারা, তাহলে আসন্ন আরো আরো সংকট মোকাবেলা করা আরো কঠিন হয়ে পড়বে, বিপন্ন হবে ভিআইপিদের নিরাপত্তাও। করোনার বার্তা শ্রমিকরাও শুনছেন, তারাও শিখছেন ‘কায়দা করে কোনমতে না বেঁচে’, ‘দামি জীবন’ নিয়ে সকলে মিলে ‘ফিট’ হয়ে বাঁচতে।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন