অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্তের অপেক্ষার দশ বছর

কল্পনা দত্তের আক্ষেপ ছিল তিন হাজার পৃষ্ঠা নিজের কথা লিখে তা হারিয়ে ফেলার। তাই স্মৃতিকথা খুব সামান্যই তাঁর পাওয়া যায়। এরপরেও কোথাও কখনও স্মৃতিকথা নিয়ে টুকিটাকি লেখার ফাঁকে ছোট কিন্তু এক দ্যুতির মতোন বেরিয়ে আসে ‘ফুটু দা’ ওরফে তারকেশ্বর দস্তিদারের নাম।

দুই সেলে দুইজন। একই মামলার আসামী। বিপ্লবের সাথী। লড়াইকালে ভালোবাসার কথা বলা হয়নি, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলা ‘অপেক্ষা কোরো’ আর তা নিয়ে দীর্ঘ দশ বছর অপেক্ষা! কল্পনা দত্তের স্মৃতিকথায়, “ধরা পড়ার পর মাস্টারদা, ফুটুদা আর আমাকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেইসময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল।” ১৯৩৪ সালে তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয়েছিল মাস্টারদার সাথেই। তবু কল্পনা দত্ত অপেক্ষা করেছিলেন। অপেক্ষা করেছিলেন দীর্ঘ দশ বছর!

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সাথে যে দুজন নারীর নাম জড়ানো তাঁদের একজন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর অন্যজন কল্পনা দত্ত। সাধারণ বাঙালিদের চেয়ে বেশ লম্বা, ছিপছিপে, গৌরবর্ণের এক ভীষণ মিষ্টি চেহারার এক নারী কল্পনা দত্ত। রবীন্দ্রনাথের অগ্নিকন্যা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। বাবা জমিজমা, বাড়ি সব বিক্রি করেন মেয়েকে বাঁচাতে! বাবা মেয়ের ভালোবাসার গল্প আর কোনোদিন হবে। শুধু এটুকু বলি, বাবার ছুটোছুটিতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, সি. এফ. অ্যান্ডুজ কল্পনার বাবাকে কথা দিলেন, তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। শেষমেশ, ১৯৩৯ সালের ১ মে আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর অঞ্চলে বোয়ালখালি গ্রামে কল্পনা দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মাতা শোভন বালা দত্ত। ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ইংরেজ প্রশাসনের আস্থাভাজন। ফলে প্রশাসনের নজরদারির বাইরে ছিল বাড়িটি। বারো বছর বয়স থেকেই দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বিপ্লবীদের জীবনী, ‘পথের দাবী’ বই পড়তে পড়তে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে তাঁর ভেতর। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি কেবল অর্থনীতিই নয়, বাংলার ভাবজগতকেও পরিবর্তিত করছে, এই উপলব্ধিটুকু জন্মাবার পরপরই ব্রিটিশদের এদেশ থেকে তাড়াবার সংকল্পে ব্রত হন।

ম্যাট্রিকে মেয়েদের মাঝে চতুর্থ স্থান অধিকার করে বেথুন কলেজে এসে সায়েন্সে ভর্তি হন। নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। যোগ দেন বিপ্লবী ছাত্রী সংঘে। বেথুন কলেজে ছাত্রীদের উদ্যোগে হরতাল পালন ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। স্কলারশিপের টাকা দিয়ে সাইকেল কিনে বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে ভোরবেলায় সবার ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেল চালানো শুরু করেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাসও করতেন।

তারপর সাড়া ফেলে দিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ঘটনা। ১৯৩০ এর ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল আর ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় কল্পনা এতটাই অনুপ্রাণিত হলেন যে, ছুটিতে চট্টগ্রামে এসে তাঁর আর কলকাতায় ফেরা হলো না। এর কিছুদিন পরেই পরিচয় মাস্টার দার সাথে পুর্নেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে। বিপ্লবী হিসেবে নারীকে নিতে অনিচ্ছুক সত্ত্বেও প্রীতিলতা আর কল্পনার একান্ত আগ্রহ মাস্টার দার সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করে। মাস্টার দা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হওয়ায় নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।

১৯৩২-এ পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হন সেদিনের নেতৃত্বে থাকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। পুরুষবেশী কল্পনা ধরা পড়তে পড়তে কোনো রকমে পালাতে পারেন আর আত্মগোপন করেন। ১৯৩৩ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা আর তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন কল্পনা। রাতে সেখানে বৈঠক করছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। পুরস্কারের টাকা বা ঈর্ষা বা উভয়ের জন্য ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। সেখানে অস্ত্রসহ সূর্যসেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়ে গেলেও অন্যান্যদের সাথে পালাতে সক্ষম হন কল্পনা দত্ত। ১৯ মে গৈরালা গ্রামে আরেক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা সতীর্থ বিপ্লবীসহ ধরা পড়ে যান।

তারকেশ্বর দস্তিদার চট্টগ্রামের সারোয়াতলীর চন্দ্রমোহন দস্তিদারের ছেলে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। সাথীরা ডাকতেন ‘ফুটু দা’ নামে।

চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে তারকেশ্বর দস্তিদারের স্থান ছিল সপ্তম। বিদ্রোহের এক মাস আগে পাহাড়তলীতে লুকিয়ে বোমা তৈরি করতে গিয়ে মারাত্মক আহত হন। বুক, হাত, মুখ পুড়ে গিয়েছিল। শরীরের হাড় পর্যন্ত নানা জায়গায় দেখা যেত। প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টে নিজের মৃত্যু কামনা করতেন। মাস্টারদার নির্দেশে গোপনে গ্রামে পাঠিয়ে চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। সুস্থ হয়ে পার্টি সংগঠনের দায়িত্বভার তুলে নেন গ্রামে।

জালালাবাদ যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। সবাই ছত্রভঙ্গ। আহত অবস্থাতেও পলাতক সঙ্গীদের জন্য ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা করতেন নিরাপদ আশ্রয়ের। মাস্টার দা ধরা পড়ার পরে সঙ্গীদের সাথে আলোচনায় বসেন। মাস্টারদাকে জেল থেকে বের করে আনতেই হবে। কৌশল খাটাতে লাগলেন জেলের ভেতর। টাকা দিয়ে ওয়ার্ডারদের বশ করে অচিরেই জেলে পৌঁছে গেল বিস্ফোরক, রিভলবার, সেলের তালা খোলার জন্য ডুপ্লিকেট চাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে যায় এই কাজে সাহায্যকারী শৈলেশ রায়। ফাঁস হয়ে গেল সবকিছু, পুলিশের নজরে চলে এলেন তারকেশ্বর দস্তিদার।

১৯৩৩ এর ১৯ মে গহিরা গ্রামে পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে গোপন মিটিং চলাকালে গ্রাম ঘিরে ফেলে পুলিশ। গুলির লড়াই চলে বেশ কিছুক্ষণ। নিহত হন মনোরঞ্জন দাস, গৃহস্বামী পূর্ণ আর তাঁর ভাই নিশি তালুকদার। ধরা পড়লেন কল্পনা, তারকেশ্বরসহ বাকি বিপ্লবীরা। ধরা পড়ার পর, মেজর কিমের জুতার আঘাতে তারকেশ্বরের চোখ দিয়ে পিচকিরির মতো বের হতে থাকে রক্ত। মামলা খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, মাস্টার দা আর তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ আর কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবনের দণ্ড দিয়ে।

ফাঁসির আগে বিপ্লবীদের স্লোগানের মাঝেই বীভৎস অত্যাচার চালানো হয় মাস্টারদা আর তারকেশ্বরের ওপরে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দাঁত, নখ সব ভেঙে দেওয়া হয়। সমস্ত জয়েন্ট আর হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, আসলে আগেই মেরে ফেলে মৃতদেহকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার ‘দি রিনাউন’—তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি এক জায়গায় ফেলা দেওয়া হয়। প্রেমিকের শহীদ হবার খবরটি কারাগারে বসেই পান। আরো নিভৃতাচারী হয়ে ওঠেন। মন দেন পড়ায়। জায়াড, কোলে, বার্নার্ড শ, রঁমা রঁল্যার আই উইল নট রেস্ট, সোউল এনচান্টেড, জাঁ ক্রিস্তোভ তার বিপ্লবী চেতনাকে আরো উজ্জীবিত করতে থাকে।

১৯৩৯ এ আন্দোলনে জেলের বাইরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন কল্পনা দত্ত। ৪০-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পরীক্ষা দেন। সেই বছরই মুম্বাইতে এক সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে পরিচয় হয় পি. সি. যোশীর সাথে। কল্পনা দত্ত স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন—“দুর্ভিক্ষের পরে বোম্বেতে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সালটা সম্ভবত ১৯৪৩। আমি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই যোশী আমায় বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বললাম, আই হ্যাভ প্রমিজড তারকেশ্বর দস্তিদার। যোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনোদিন আসবে না। … তাও আমি দোনামোনা করছিলাম। বিটি (বিটি রণদিভে), ডক (ডঃ গঙ্গাধর অধিকারী) এর ইনসিস্ট করাতে বিয়ে করলাম।”

১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কল্পনা দত্ত বেঁচে ছিলেন। লড়াই আর আত্মত্যাগের শিক্ষা থেকে কোনোদিন বিচ্যূত হননি। অস্ফুট সেই মৌনতা ঘেরা ভালোবাসা আজীবনই কি ধরে রেখেছিলেন? আমাদের ধারণা রেখেছিলেন, না-হয় কেনই বা স্মৃতির কথায় বেরিয়ে আসে সেই মৌন সম্মতিতে দেওয়া অপেক্ষার দশ বছর!

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন