দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৫টিতে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করেছে

করোনাভাইরাসে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন করোনাক্রান্ত রোগীর প্রায় ৮৯ শতাংশই মারা যাচ্ছে। দেশে এখন পর্যন্ত ৯ জন রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮ জনই মারা গেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোববারের এ সংক্রান্ত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে ৩১২ জনের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এখনও একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন জেলার মানুষ। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৫টিতে ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করেছে। সারা দেশে এ পর্যন্ত ২৪৫৬ জন শনাক্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৯১ জন।

খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোববারের ব্রিফিংয়ে বলেন, যেভাবে আমরা আশা করছি লকডাউন সেভাবে কাজ করছে না। মানুষ আক্রান্ত এলাকা থেকে ভালো এলাকায় যাচ্ছেন। ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এসব এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এরাই ছড়িয়েছে। এখনও লুকিয়ে বিভিন্ন উপায়ে যাচ্ছে। ফলে নতুন করে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক বিস্তৃতি) বেড়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ রুখতে এটা (গোপনে অন্যত্র যাওয়া) কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তিনি এলাকায় এলাকায় দৃষ্টি প্রসারিত করার আহ্বান জানান। সংক্রমণ ঠেকাতে সব স্তরের মানুষের সচেতনতা জরুরি বলে উল্লেখ করেন।

বিশিষ্ট চিকিৎসকদের বরাদ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীর ৮০ শতাংশ ঘরে কোয়ারেন্টিনে থেকে চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ১৫ শতাংশের হাসপাতালে পরিচর্যা দরকার। বাকি ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর হতে পারে, যাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিনে আইসিইউর ফলাফল ভালো পাওয়া যায়নি। করোনায় আক্রান্ত যে ৯ জনকে ভেন্টিলেটরে নেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে আটজনই মারা গেছেন।

এদিকে করোনাভাইরাসে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন জেলা। এখন পর্যন্ত ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৫টিতেই ২৪৫৬ জনের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে ৩১২ জনই চিহ্নিত হয়েছে ২৪ ঘণ্টায়। এ সময়ে মারা গেছেন ৭ জন। শনাক্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বেশি, তবে মৃত্যুর হার তিন দিনের মধ্যে সর্বনিু। অন্যদিকে নতুন নতুন এলাকায় এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। যে কারণে একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রোববার রাত পর্যন্ত ৩৩ জেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সাগরপারের জেলা পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি নির্দেশনায় একেবারেই অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া এক এলাকার মানুষ আরেক এলাকায় যেতে পারবে না। সন্ধ্যার পর কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। এমনকি অপ্রয়োজনে দিনের বেলাও বের হতে পারবে না। এই তিনটি কাজই আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু এসব নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। জনগণও বুঝতে চাচ্ছে না এর ভয়াবহতা। যে কারণে পাওয়া যাচ্ছে না প্রত্যাশিত ফল।

তবে বিশিষ্ট চিকিৎসকরা আশার আলো দেখছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল যুগান্তরকে বলেন, শতভাগ কার্যকর লকডাউন কোনো দেশই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সাড়ে ১১ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বলা হয়েছে, ঘরে থেকো না, কাজে নামো। এভাবে তৈরিকৃত ‘একটিভ পপুলেশন’কে ঘরে ঢোকাতে সময় লাগছে। তবে চলমান তৃতীয় দফার ছুটিতে জনগণের ঘরে থাকার নির্দেশনা প্রতিপালনের প্রবণতা বেড়েছে। শুরুতে মানুষ মনে করেছিলং কিচ্ছু হবে না। এছাড়া কী খাব, কী করব- এমন চিন্তা ছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা বেড়েছে। মানুষের খাওয়ার চিন্তা কমেছে। বিপরীত দিকে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। ফলে ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও কমেছে।

নিয়মিত ব্রিফিং : অনলাইন ব্রিফিংয়ে নিজের বাসা থেকে সংযুক্ত হয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। তার সঙ্গে ছিলেন অধিদফতরের এমআইএস পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান খান।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মহামারী করোনাভাইরাস দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও সাতজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৯১ জন। করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৭৪৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে পরীক্ষা করা হয় দুই হাজার ৬৩৪ জনের নমুনা। এদের মধ্যে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৩১২ জন। আর রোববার পর্যন্ত সব মিলিয়ে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২৩ হাজার ৮২৫ জনের। মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল দুই হাজার ৪৫৬ জনে।

মন্ত্রী আরও জানান, সুস্থ হয়ে উঠেছেন আরও নয়জন। ফলে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৭৫। এ সময় মন্ত্রী বলেন, গত কয়েকদিনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনশ’র কাছাকাছি রয়েছে। এটা যদি আর না বাড়ে তাহলে আমরা ভাগ্যবান। করোনা যুদ্ধে জয়ের মূলমন্ত্র ঘরে থাকা। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঘরে থাকতে হবে। একটু কষ্ট করে ঘরে থাকুন, তাহলে আমাদের জয় আসবেই।

তিনি কিছুটা তৃপ্তি প্রকাশ করে বলেন, আমরা এখন আক্রান্তের সপ্তম সপ্তাহে আছি। ইউরোপ-আমেরিকায় এ সময়টাতে (আক্রান্তের সপ্তম সপ্তাহে) লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে হাজার হাজার মানুষ। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলি, তাহলে আমাদের অবস্থাও ভালো হবে না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায় পরিস্থিতি অনেক দেশের চেয়ে ভালো।

তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলো এগিয়ে এসেছে। তার মধ্যে দুটি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। নতুন করে কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভাগীয় শহরে করোনার জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলা শহরগুলোকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হওয়া ৩১২ জনের মধ্যে ৬৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৪ শতাংশ নারী। তাদের ভেতরে ঢাকার রয়েছে ৪৪ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জে ৩১ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ সারা দেশের। মৃত রোগীর মধ্যে ৫ জন পুরুষ, ২ জন নারী; যাদের মধ্যে আবার ঢাকার ৩ জন, ৪ জন নারায়ণগঞ্জের। তিনি আরও বলেন, শনাক্ত রোগীর মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২২ দশমিক ৩ শতাংশ আর ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ৩ হাজার ৮৯২ জন। এখন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ৪৭৯ জন। এখন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ৫ হাজার ৩১৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মোট কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৩৭১ জনকে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ১৩৫ জনকে কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে। কোয়ারেন্টিন থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ছাড়া পেয়েছেন ১ হাজার ৫৭৪ জন। মোট ছাড়া পেয়েছেন ৭২ হাজার ৯৬৭ জন।

তিনি বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘অক্সিজেন থেরাপি’ ভালো কাজে দিচ্ছে। এজন্য আরও তিন হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করেছি। বর্তমানে সংগ্রহে আছে প্রায় দশ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার আদেশ দেয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্রিফিংয় বলেন, শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জানাজায় হাজার হাজার মানুষ শরিক হয়েছে। এই সময়ে এ ধরনের জমায়েত খুবই ক্ষতি হয়েছে। আশঙ্কা করি, অনেক লোক এখান থেকে হয়তো বা আক্রান্ত হয়েছে। এ ধরনের দায়িত্বহীন কাজ কোনোভাবেই উচিত হয়নি। এখানে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ ধরনের জমায়েত পরিহার করুন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের জমায়েত খুবই ক্ষতিকর।

৫৫ জেলায় করোনাভাইরাস : রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেয়া সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৫টিতেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে ঢাকা মহানগরীতে। রোববার পর্যন্ত ঢাকা সিটিতে ৯৭৪ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

ঢাকা বিভাগ : ঢাকা জেলায় ৪০, নারায়ণগঞ্জ ৩৮৬, গাজীপুর ১৭৩, কিশোরগঞ্জ ৭৭, মাদারীপুর ২৬, মানিকগঞ্জ ৬, মুন্সীগঞ্জ ৩৩, নরসিংদী ১০৫, রাজবাড়ী ৭, ফরিদপুর ৪, টাঙ্গাইল ১০, শরীয়তপুর ৭, গোপালগঞ্জ ২১। চট্টগ্রাম বিভাগ : চট্টগ্রাম ৩৯, কক্সাবাজার ১, কুমিল্লা ১৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১১, লক্ষ্মীপুর ২১, বান্দরবান ১, নোয়াখালী ৩, ফেনী ২, চাঁদপুর ৮। সিলেট বিভাগ : মৌলভীবাজার ২, সুনামগঞ্জ ১, হবিগঞ্জ ১, সিলেট ৩। রংপুর বিভাগ : রংপুর ৫, গাইবান্ধা ১২, নীলফামারী ৯, লালমনিরহাট ২, কুড়িগ্রাম ২, দিনাজপুর ১০, পঞ্চগড় ১, ঠাকুরগাঁও ৬। খুলনা বিভাগ : খুলনা ১, যশোর ১, বাগেরহাট ১, নড়াইল ২, চুয়াডাঙ্গা ১। ময়মনসিংহ বিভাগ : ময়মনসিংহ ২১, জামালপুর ২০, নেত্রকোনা ১৪, শেরপুর ১১। বরিশাল বিভাগ : বরগুনা ১০, বরিশাল ২১, পটুয়াখালী ২, পিরোজপুর ৪, ঝালকাঠি ৪, ভোলা। রাজশাহী বিভাগ : জয়পুরহাট ২, পাবনা ২, বগুড়া ১, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীতে ৪।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন