জাতীয় পার্টিতে (জাপা) চলমান দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ গত রবিবার দেশে ফেরেন। ফেরার তৃতীয় দিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার সকালেই বৈঠক করেছেন দেবর পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে। দুজনের একান্ত বৈঠকে মান-অভিমান প্রকাশ ও পারিবারিক খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি পার্টির চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো বিষয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রওশনপন্থি এক নেতা দেশ রূপান্তরকে জানান, সমন্বিতভাবে কাজ করার ব্যাপারে দুজনই একমত হয়েছেন। তবে সেই প্রক্রিয়া কী হবে এবং কীভাবে সংকটের সমাধান করা যায়, তা অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান রওশন এরশাদ। এই নেতা আরও বলেন, বৈঠকে রওশন এরশাদ কাদেরকে জানিয়েছেন, পরে তারা কোথায় ও কীভাবে বসবেন, সে ব্যাপারে পরে জানাবেন। এরপর উভয় পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় বসবেন বলেও জানান।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে অবস্থানরত রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যান কাদের। এ সময় তার সঙ্গে জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ছিলেন। রওশনের সঙ্গে জাপার সাবেক এমপি এম এ গোফরান, ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ এমপি ও রওশনপুত্রবধূ মাহিমা সাদ উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় রওশন ও কাদের উভয়ে নিজ নিজ স্বাস্থ্য ও পরিবারের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নেন। পরে তারা দুজন একান্তে প্রায় ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেন। এর আগে তারা একসঙ্গে নাশতাও করেন। অন্যদিকে, জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিম্ন আদালতের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার আদেশ হাইকোর্ট স্থগিত করেছেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে জি এম কাদেরের পক্ষে হাইকোর্টে করা রিভিশন আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়ালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়। ফলে জাতীয় পার্টির বিষয়ে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই বলে জানান তার আইনজীবীরা।
কী কথা বললেন রওশন-কাদের: দুজনের একান্ত বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রওশনপন্থি এক নেতা জানান, কাদেরের বিরুদ্ধে নিজের খোঁজখবর না নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন রওশন। দেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে দেখতে না যাওয়া, উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে বিদায় জানাতে না যাওয়া এবং থাইল্যান্ডে থাকাকালে খোঁজখবর না নেওয়ার অভিযোগ করেন। এ সময় দুজনের মধ্যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রওশন কাদেরকে বলেন, তিনি ভাবি হিসেবে তাকে ছেলের মতো করে দেখাশোনা করেছেন। পার্টিতে ক্ষমতা দিয়েছেন। অথচ সে (কাদের) তাকে (রওশন) ভুল বুঝেছে।
বৈঠকে কাদেরের উদ্দেশে রওশন আরও বলেন, তিনি কাদেরের কোনো ক্ষতি করেননি। ক্ষতি করেছেন তার (কাদের) চারপাশের নেতারা, যাদের নিয়ে তিনি চলাফেরা করেন। এ সময় সাদ এরশাদও তার চাচার বিরুদ্ধে তার খোঁজখবর না নেওয়ার ব্যাপারেও অভিযোগ তোলেন। পরে কাদের অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করেন রওশনকে। এ সময় তিনি রওশনের সঙ্গে সমন্বয় ও পরামর্শ করে পার্টির কাজ করার ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে সেই সমন্বয় কীভাবে হবে, তা নিজেদের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে পরে জানাবেন বলে রওশন জানান।
বৈঠকের ব্যাপারে রওশনপন্থি ও কাদেরপন্থি নেতারা জানান, বহিষ্কৃত ও দলত্যাগীদের দলে ফিরিয়ে আনা, ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন, প্রধান পৃষ্ঠপোষকসহ সবার পরামর্শে পার্টির কার্যক্রম পরিচালনা, রংপুর সিটি নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এবং দলীয় রাজনীতির সৃষ্ট সংকট নিয়ে দুজন আলোচনা করেছেন। বৈঠকের বিষয়ে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি দেশ রূপান্তরকে বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান ও আমরা পল্লীমাতা বেগম রওশন এরশাদের দোয়া নিতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। তিনি আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। আমাদের দোয়া করেছেন। আমাদের অভিভাবক হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, তারা দুজন (রওশন ও কাদের) অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেছেন। তারা এক টেবিলে বসে নাশতা করেছেন। সেখানে শুধু তাদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। প্রতিটি দলের অভ্যন্তরেই ঝামেলা থাকে। তবে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিল না। তারা সব সময় একসঙ্গেই ছিলেন। আসলে জি এম কাদের দলকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে গেছেন।
এর আগের দিন গত সোমবার রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ। সেদিন সন্ধ্যায় রওশনের সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে দেখা করেন মোস্তফা। পরে রসিক নির্বাচনে তার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে মোস্তফাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন কাদেরপন্থিরা। তার মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গত রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন রওশন এরশাদ।