দেশে চিকিৎসকদের আক্রান্তের সংখ্যাটা এতো বেশি কেন? সমস্যাটা কোথায়!

জানি ডা. মঈনের মুত্যুতে আমরা সবাই গভীর শোকের মধ্যে আছি। প্রবল আবেগের মধ্যেও আছি আমরা। কিন্তু সেই আবেগ থেকে বের হয়ে আমাদের বাস্তবতার দিকে তাকাতে হবে, বাস্তবতার নিরিখে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও করতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কোটি মানুষকে বাঁচানোর লড়াইয়ে আছি আামরা। বাস্তবতাকেই আমাদের পাথেয় করতে হবে।

ড. মঈন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার চিকিৎসা হয়নি, রাষ্ট্র তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি সে কথা আমরা জানি। কিন্তু ডা. মঈন সংক্রমিত হলেন কিভাবে? আরও একশতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী যে সংক্রমিত হয়েছেন- সেটি কিভাবে ঘটলো? আমরা কি এই তথ্যটা জানি? এই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি? চিকিৎসক বন্ধুরা কি ভেবেছেন? না ভেবে থাকলে এখন এটি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। নইলে আগামী দিনগুলোতে আমাদের হাহাকারই করতে হবে কেবল।

স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের ফ্রন্টলাইনার। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর আগেই যদি তারা সংক্রমিত হয়ে পরেন, তাদের মরে যেতে হয় তা হলে মানুষ বাঁচাবে কারা? মানুষ বাঁচানোর দায়িত্বটা তাদের হাতেই বলে এই ভাবনাটা্কেও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার।

ব্যক্তিগত ভাবে নেবেন না, এটি কোনও অপবাদ দেয়া বা দোষ ত্রুটি ধরার কসরত না। আমার লেখা যারা ফলো করেন তারা নিশ্চয়ই এটি বুঝবেন। একটা প্রশ্ন করি, আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে, এর বিস্তার সম্পর্কে, চিকিৎসা সম্পর্কে কতোটা সচেতন? কতোজন সচেতন?

জানি অনেকেই চিৎকার করে বলে উঠবেন- সরকার কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি, কিভাবে জানবো। কেউ কেই বলবেন, জানি- অনেক জানি। । সরকার যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নাই করে তাতে কি? পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে তোলা একটা রোগ বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন হবো না!

রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য না হোক, নিজেকে বাঁচানোর জন্য, নিজের পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর জন্য, স্বজনদের বাঁচানোর জন্য প্রস্তুতি নেবো না আমরা! সেই প্রস্তুতিটা কি আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা নিয়েছেন!

জানি, অনেকেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) কথা বলবেন। সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীই কি আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে? অবশ্যই না। ইতালীতে, আমেরিকায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত চিকিৎসকেরও মৃত্যু হয়েছে। কেন হয়েছে জানেন? সেটাও জানা দরকার। বাংলাদেশে এখনো ইতালি বা আমেরিকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবু চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাটা এতো বেশি কেন? সমস্যাটা কোথায়!

আপনি হয়তো বলবেন বাংলাদেশের কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কে আক্রান্ত না- বোঝা মুশকিল, লোকজন তথ্য গোপন করে- সবই সত্য। এইসব বিবেচনায় নিয়েই কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনা কালে রোগীদের কিভাবে সেবা দিতে হবে একটা নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে। সেটি পড়ে দেখলে, সেই নির্দেশিকা অনুসরণ করলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।

করোনা ভাইরাসের রোগীদের কিভাবে চিকিৎসা করতে হবে তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও কিন্তু করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ১.৯ মিলিয়ন স্বাস্থকর্মী এই কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা কিন্তু জটিল কোনো চিকিৎসা নয়, এর চেয়ে জটিল চিকিৎসা, অপারেশন আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা বাংলাদেশের হরহামেশাই করছেন। সেগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না তো! তা হলে!

করোনাটা নতুন বলেই তো যতো সমস্যা! সেই নতুন জিনিসটা জানানোর ব্যবস্থা তো করা আছে একেবারে বিনামুল্যে, নিজের ঘরে বসেই সেটা জানা যাচ্ছে। নিজের জন্যও হলেও তো সেগুলো জানবেন।

আজ দেখলাম- বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নতুন একটা কোর্স যুক্ত করেছে। সেটি হচ্ছে পিপিই কিভাবে পরতে হবে এবং খুলতে হবে। তার মানে কি? পিপিই কেবল থাকলেই হবে না, সেটি পরতে এবং খুলতে জানতে হবে। এই পরা এবং খোলা নিয়ে নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে, হচ্ছে বলেই তো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। তার মানে কি? পিপিই থাকলেও আপনি আক্রান্ত হতে পারেন, অপনি ভাইরাস ছড়াতে পারেন- যদি এটি কিভাবে পরতে ,খুলতে হয় সেটা না জানেন। গ্লাভস নিয়ে, মাস্ক নিয়েও একই কথা।

জানতে চেয়েছিলাম ডা. মঈন কিভাবে সংক্রমিত হয়েছেন সে তথ্য কারো কাছে আছে কী না, শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী কিভাবে আক্রান্ত হলেন সে তথ্যটা আছে কী না। ভাইরাসতো হাওয়ায় উড়ে কারও শরীরের ভেতর ঢুকে যায়নি। গবেষকদের বের করা ‘মানবদেহের পয়েন্ট অব এন্ট্রি’ গুলো দিয়েই দেহে ঢুকেছে । ভাইরাসটা আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের শরীরের পয়েন্ট অব এন্ট্রি পর্যন্ত গেলো কিভাবে? ডাক্তাররা কি ইচ্ছে করে সেখানে নিয়ে গেছেন?

মোটেও তা না। কেউই ইচ্ছে করে নিজের দেহে ভাইরাস নিয়ে যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের হাত দিয়েই, আমাদের স্পর্শ দিয়েই ভাইরাস শরীরে যায়, স্বাস্থ্যকর্মীদের শরীরে গেছে, ডা. মঈনের শরীরে গেছে। ইতালী আমেরিকায় মারা যাওয়া, আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসকদের শরীরেও এইভাবেই ভাইরাসের সংক্রমন ঘটেছে। ইতালী আমেরিকায় রোগীর প্রচন্ড ভীড়ে হিমসিম খাওয়া চিকৎসকের হয়তো বোঝারই উপায় ছিলো না কখন কোন জিনিসটা তারা ছুঁয়ে দিয়েছেন, তারপর ব্যস্ততায়, রোগীর চাপে হয়তো বুঝেই উঠতে পারেননি সেই হাত তারা কখন নাকে মুখে কিংবা ব্যক্তিগত অন্য কোনো কিছুতে স্পর্শ করে জীবাণুটাকে জমিয়ে রেখেছেন। তারপর কোনো এক সময় অবচেতনভাবেই নাক, মুখ স্পর্শ করেছেন।

বাংলাদেশের এখনো তাদের মতো রোগীর চাপ তৈরি হয়নি। যদি হয় তাহলে সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রস্তুতি তো আমাদের চিকিৎসকদের থাকতে হবে। সে জন্যই বলি, স্বাস্থ্যকর্মীরা কিভাবে সংক্রমিত হয়েছেন, হচ্ছেন যদ্দুর সম্ভব সেটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আগামী দিনে করোনা ভাইরাস বিরোধী লড়াইয়ে আমাদের ফ্রন্টলাইনারদের সুস্থ রাখার জন্যই এই আলোচনা দরকার।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন