মুসলমান সভ্যতায় পাঠাগারের ভূমিকা

জ্ঞানার্জনের জন্য পড়তে হয় বইপুস্তক। মানুষ যাতে সহজেই বই সংগ্রহ করে জ্ঞানার্জন করতে পারে সে জন্য বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পাঠাগার। পাঠাগার হচ্ছে একটি মুসলিম ঐতিহ্য। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলমানরা শুধু আধ্যাত্মিকতার প্রোজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত একটি মানবগোষ্ঠী হয়েই আত্মপ্রকাশ করেনি, সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণকর জাগতিক বিষয়েও অসামান্য অবদান রেখেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে চর্চা, সাধনা ও অধ্যবসার শ্লথগতির কারণে মুসলিমদের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকেনি। ইতিহাস থেকেই জানা যায়, রসায়নের জনক হলেন জাবির ইবনে হাইয়ান। আলোকবিজ্ঞানের জনক ইবনুল হাইসাম।

গণিতবিদ আল-জাবের, চিকিৎসায় ইবনে সিনা, জ্যোতির্বিজ্ঞানে আল-বিরুনিসহ মুসলিমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন, আজকের বিজ্ঞান তার কাছে বিপুলভাবে ঋণী। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বলেই দীর্ঘ আট শ বছর মুসলমানরা দাপটে নিয়ন্ত্রণ করেছে বিশ্বসভ্যতাকে। দিল্লির বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সাইন্স টুডে’ ১৯৮০ সালের নভেম্বরে এক লেখা প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল : Arabs_founders of modern science? (আরব কি আধুনিক বিজ্ঞানের জনক?) সেখানে লেখা রয়েছে : ‘অ্যারিস্টটল, প্লেটোসহ অনেক বৈজ্ঞানিকই আরব-মুসলিম বিজ্ঞানীদের থেকে বহু বিষয়ে জ্ঞান আহরণের কথা বর্ণনা করেছেন। এমনকি নিউটন যে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত হলেন, তা-ও নাকি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বেঁচে থাকা এক আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানীর লেখা থেকে।’

পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খলিফা হারুন-অর রশিদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) খিজানাতুল হিকমা বা জ্ঞান গ্রন্থাগার। এরপর খলিফা মামুন প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন বিজ্ঞান ইনস্টিটিউশন—বায়তুল হিকমা বা জ্ঞানগৃহ (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)।শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, মধ্যযুগে যখন গোটা ইউরোপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, গ্রানাডা ও কর্ডোভাসহ মুসলিম দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদের খলিফারা ‘দারুল হিকমা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ বিশ্বখ্যাত মনীষীর গ্রন্থাবলি গ্রিক ভাষা থেকে আরবি এবং পরবর্তীকালে লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। এর মাধ্যমে মুসলমানরা ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছে।

শুধু গ্রিক ও ইউরোপই নয়, প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামের আগমনের আগে প্রচলিত শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনেরও সংরক্ষণ করেছে মুসলমানরা। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, হালাকু খান বাগদাদ দখল করে ‘দারুল হিকমাতে’ আগুন ধরিয়ে দিলে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় পাঠাগারটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাই দজলা নদীতে নিক্ষেপ করা হলে দীর্ঘ ছয় মাস দজলা নদীর পানি কালো রং ধারণ করে।

ইউরোপে যখন কোনো স্কুল ছিল না তখন স্পেনের মুসলমানরা জ্ঞানচর্চার জন্য যে অগণিত বই ব্যবহার করত, তার নামের তালিকা ছিল ৪৪ খণ্ডে বিভক্ত! আধুনিককালে তুরস্কের ‘সোলাইমানিয়া’ লাইব্রেরির অবস্থান শীর্ষে।

ঐতিহ্য, বিশালতা ও সংগ্রহের বৈচিত্র্যে এটি অনন্য। তারপর মিসরের ‘দারুল কুতুব’ যা প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ইরাকে আবদুল্লাহ মারাশি নাজাফি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত লাইব্রেরিটি ইসলামী দুনিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম বলে দাবিদার। এ লাইব্রেরিতে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর ইসলামী সংস্কৃতির দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে। হাতে লেখা প্রাচীন কোরআন শরিফখানাও এ পাঠাগারের হেফাজতে। প্রাচীন হস্তলিপি সংগ্রহের দিক দিয়ে এ পাঠাগারটি শ্রেষ্ঠতম, এক লাখেরও বেশি প্রাচীন হস্তলিপি এখানে জমা আছে।

বিজ্ঞানী ইবনে রুশদের ভূগোলসম্পর্কীয় কিতাব ‘আল কানুন’, খাজা নাছির উদ্দিন তুসির চিকিৎসাবিজ্ঞান শাস্ত্র ‘তাহরিরে একলিদেস’ ও শরিফ ইদ্রিসের ‘নাজহাতুল মুস্তাক’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মূল পাণ্ডুলিপি এখনো বিদ্যমান আছে। গ্রন্থসংগ্রহ ও জ্ঞানচর্চার সুবিধার্থে পবিত্র নগরী মদিনায় স্থাপন করা হয়েছে ‘মাকতাব আল আবদুল আজিজ’। এটি মসজিদে নববীর বারান্দার পশ্চিম অংশে অবস্থিত। ইসলামী সভ্যতা ও জ্ঞানচর্চার স্বর্ণালি যুগের মিউজিয়ামও বটে।

এ পাঠাগারের সংগ্রহ ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডারের এক বিশাল অমূল্য সম্পদ। সারা দুনিয়ার দুর্লভ ইসলামী প্রকাশনার পাণ্ডুলিপিসহ অসংখ্য বৈচিত্র্যে ভরা পবিত্র কোরআন, হাদিস ও ধর্মীয় কিতাবের বিশাল সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে। শুধু কোরআনে কারিমের পাণ্ডুলিপি রয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৭৮টি। এর সঙ্গে রয়েছে ৮৪টি হস্তলিখিত কোরআনের বিশেষ অংশ। দুর্লভ অমূল্য কিতাবই আছে প্রায় ২৫ হাজার।

৪৮৮ হিজরিতে আলী বিন মুহাম্মদ আল বাতলিওসি কর্তৃক হরিণের চামড়ার ওপরে লিখিত পবিত্র কোরআনসহ ১৫৮ কেজি ওজনের বৃহদাকার হস্তলিখিত পবিত্র কোরআনের কপিটি এ লাইব্রেরির অহংকার, যা গোলাম মুহিউদ্দিন কর্তৃক লিখিত। ‘মাকতাবাত আবদুল আজিজ’ পাঠাগারটি তথ্যগ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি, অভিসন্দর্ভ, গবেষণাপত্র ও অত্যাধুনিক সুবিধাদির জন্য বিশ্ববিখ্যাত।

এভাবেই মুসলিম সভ্যতায় গড়ে উঠেছিল বৈচিত্র্য পাঠাগার।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন