ভয়কে জয় করতে দরকার আত্মবিশ্বাস এবং সাহস

প্রায় ১৮ বছর আগের কথা। আমার বাবাকে নিয়ে আমেরিকার ক্যার্লিফোনিয়া গিয়েছিলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়েও ছিল। আমার দ্বিতীয় বোন জলি মৃধা লংবিচ (California State University) থেকে তখন তার লেখাপড়া শেষ করেছে। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মূলত সে কারণেই বাবাকে নিয়ে সেখানে যাওয়া।

ছেলে বাংলাদেশি। বুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ইউসিএলএ (University of California, Los Angeles) থেকে মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করছে লসঅ্যাঞ্জেলসে। সবকিছু দেখে শুনে বিয়ের কাজ সারা হলো। আমরা সবাই কিছুদিন একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করলাম। অতঃপর বাবাকে জলির ওখানে রেখে নিউইয়র্কে এলাম আমার ভেনিজুয়েলান এক বান্ধবীর বাড়িতে।

বান্ধবী সুইডেনে আমার সঙ্গে পড়েছে বহু বছর আগে। অনেকবার বলেছে আমেরিকা এলে যেন তার ওখানে যাই। বান্ধবীর নাম জেনিন। চাকরি করে ফাইজারে, স্প্যানিশ ভাষী। তাই জমবে ভালো আমার স্ত্রীর সঙ্গে, কারণ সেও স্প্যানিশ জানে। তাছাড়া জেনিনের সঙ্গে টেলিফোনে সুইডেন থেকে নিউইয়র্কে আমার কথা হয়। এবার তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর পরিচয় হবে।

জেনিনের বাড়িতে ঢুকেই একটা জিনিস দেখে খুব অবাক হলাম। তার স্বামী ফ্রেডরিকো হাইজিন সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করি। হাইজিন সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সচেতন থাকা সত্ত্বেও ফ্রেডরিকোর অ্যাক্টিভিটিস দেখে মনে হয়েছিল তার খুব শুচিবায়ু।

আমরা মোটামুটি অ্যাডজাস্ট করে সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলাম। আসার দিন জেনিনকে বললাম, এটা তেমন কোনো সমস্যা না, তুমি ম্যানেজ করে নিও। সে সত্যিই ম্যানেজ করে চলছে এখন পর্যন্ত। তবে এবারের করোনাভাইরাস জেনিনের অতীতের সব জ্বালাযন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে! স্বামীর সঙ্গে তার সব দূরত্ব দূর করে দিয়েছে। সে যা শুনছে, দেখছে এবং নিজেও করছে অর্থাৎ বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যাবহার করা, জুতা ও জামাকাপড়সহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত রাখা, পরস্পর পরস্পর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি কোনো কিছুই জেনিন এবং তার পরিবারের জন্য নতুন কিছু না।

১৮ বছর এই শুচিবায়ুর কারণে অনেক সময় ঝগড়া হয়েছে। যখন কেউ তাদের বাড়িতে আসে এবং তাদের যাবার পরপরই সব কিছু সানিটাইজেশন করতে হয়, নইলে তার স্বামী রাতে ঘুমাতে পারে না। তার তিনটি গাড়ি একটি শুধু কাজে যাবার জন্য, একটি পরিবারের সবাই মিলে বাইরে যাবার জন্য, আর একটি রয়েছে শুধু জেনিন এবং তার স্বামী ফ্রেডরিকোর পারসোনাল ব্যবহারের জন্য।

লন্ড্রি করার সময় ফ্রেডরিকো তার মোজা, আন্ডারওয়ার, শার্ট, প্যান্ট সবই যেমন আলাদা করে রাখে, তেমন পরিষ্কারও করে সব আলাদাভাবে। আমি বেশ কিছুদিন ধরে বিষয়টি ভেবেছি, কিন্তু জেনিনকে কিছু বলিনি। গতকাল সে নিজ থেকে বলেছে ‘আঠারো বছর যে জিনিসগুলো নিয়ে ফ্রেডরিকোর সঙ্গে ঝগড়া করেছি আজ সারা পৃথিবীর মানুষ তাই করছে করোনাভাইরাসের কারণে।’ সে কখনও ভাবতে পারেনি একদিন সবার আচরণ তার স্বামীর মতো হবে! জেনিনরা থাকে কুইন্সে। যেহেতু করোনা শরীরে ঢুকেছে কিনা তা ফ্রেডরিকো এখনও জানে না, বিধায় সে এখন প্রতি দশ মিনিট পরপর তার শরীরের তাপমাত্রার ফলোআপ করছে। সেই সঙ্গে গোসলের সময় নির্ধারণ করেছে সকাল এবং সন্ধ্যায়।

ফ্রেডরিকোর বর্তমান সময় পার হচ্ছে খুব স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে। সে প্রতিনিয়ত জেনিনকে বলছে তাকে করোনা আক্রমণ করেছে যা নতুন করে জেনিনকে যেমন বিরক্ত করে তুলছে একইসঙ্গে চিন্তিতও করছে। জেনিনের চিন্তা এভাবে যদি সে সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকে তবে তার শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হতে থাকবে। পরে যদি সত্যি সত্যিই তাকে করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ ধরে তবে তার জন্য করোনাকে রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। গতকাল ফ্রেডরিকোর পরিবারকে বিষয়টি জেনিন বলেছে, যেন তাদের তরফ থেকে বিষয়টি তাকে বোঝানো হয়।

আমাদের পৃথিবীতে প্রতি বছর ৬০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। মিডিয়া কখনই এদিকে তেমন মনোযোগ দেয় না। এখন কোভিড-১৯ এর কারণে মিডিয়া প্রতিটি মৃত্যুর হিসাব গণনা করে ভয়, আতঙ্ক, সংকট তৈরি করছে, যা আমাদের অনেকের মাঝে ফ্রেডরিকোর মত আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। কোভিড-১৯ রোগ প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই প্রথম গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কোভিড-১৯ কারো শরীরে আছে কি নাই সেটা ১০০% নিশ্চিত হওয়া দরকার। বর্তমান বিশ্বে নানা ধরণের কিট ব্যবহৃত হচ্ছে এটা সনাক্ত করতে। তবে PCR (Polymerase Chain Reaction) একমাত্র সঠিক ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম যা সাউথ কোরিয়া ব্যবহার করছে।

যদি একটি গ্রহণযোগ্য কিট যা PCR-এর মত সঠিক তথ্য দিতে পারে তবে কোভিড-১৯ ফলাফল পেতে এবং মৃত্যুর হার কমাতে হাসপাতালগুলো সক্ষম হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উপজেলা লেভেলে এমন একটি PCR থাকতে হবে যা কোভিড-১৯ ভাইরাস সনাক্ত করতে সক্ষম হবে। সেটা করা গেলে দেশের সবাইকে ঢাকায় আসার দরকার হবে না।

সাউথ কোরিয়া বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং মনিটরিং করতে সক্ষম হয়েছে। কোভিড-১৯ পৃথিবীজুড়ে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তাতে সমগ্র মানব জাতি চিন্তিত। এই আতঙ্ককে জয় করতে যে জিনিসটির বেশি দরকার তা হলো আত্মবিশ্বাস এবং সাহস। আমাদের সবার সচেতনতাই দূর করতে পারে ভবিষ্যতের ক্ষতিসাধন।

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন