কাছের মানুষের স্মৃতিতে সালমান শাহ

আজ ঢালিউড সুপারস্টার সালমান শাহর ২৫তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৬ সালের এই দিনে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে তার অকালে চলে যাওয়া আজও ভক্তদের হৃদয়ে ক্ষত হয়ে আছে। প্রিয় এই তারকাকে স্মরণ করেছেন তার কাছের তিনজন মানুষ। লিখেছেন মাসিদ রণ তার সমাধির যত্ন নেওয়া হোক সোহানুর রহমান সোহান, চিত্রপরিচালক

সালমানকে প্রায়ই মনে পড়ে। তাকে আমি চলচ্চিত্র অঙ্গনে এনেছিলাম। আমার পরিচালনায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু। ঢালিউডে দুই বড় তারকার জন্ম হয় সেই সিনেমা দিয়ে। সালমান শাহ আর মৌসুমী। একটা সময় আমার আর সালমানের মধ্যে মান অভিমান হয়। বেঁচে থাকতে আমিও তার মূল্য বুঝিনি। তাই সেই অভিমান পুষে রেখেছিলাম। কিন্তু সে নিজেই মারা যাওয়ার তিন মাস আগে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্পর্কটার বরফ গলিয়ে ফেলে।

সে তো মনের দিক থেকে আমার সন্তানের মতো ছিল। তাই তাকে আর দূরে রাখতে পারিনি। আমাদের সম্পর্ক আগের মতো হতে না হতেই তাকে নিয়ে নতুন সিনেমার পরিকল্পনা করি। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস। সে চলে গেল, সিনেমাটি আর হলো না। অনেকে জানেন না, সেই সিনেমাটি দিয়েই ঢালিউডে আবারও আত্মপ্রকাশ করেন আরেক সুপারস্টার। তাকে এখন ঢালিউড কিং বলে সবাই। বলছি শাকিব খানের কথা। কিন্তু এরপর তারকাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের কষ্ট পাওয়ার পর বারবার সালমানের কথা মনে হতো। সে আমাকে পিতার মতো সম্মান করত। আমাদের বোঝাপড়াটাই ছিল আলাদা।

সে আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই অনেক সিনেমা করা হতো একসঙ্গে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর আসে, সালমান আমাদের মনে গভীরভাবে ধরা দেয়। বিশেষ করে ৬ সেপ্টেম্বর তার প্রয়াণ দিবস আর ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মদিবস। এই দুটি দিন তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু ক্লান্ত হয় না আমার মন, তাকে মিস করা কিংবা তার সেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। একটা ক্ষণজন্মা ছেলে, যে এসেছিল অসম্ভব মেধা আর রুচিবোধ নিয়ে। এজন্যই সে সবার চেয়ে আলাদা।

মৃত্যুর এত বছর পরও তাকে ঘিরে দর্শকের যে উন্মাদনা দেখি তাতে গর্ব হয়। তাকে তো আমিই খুঁজে বের করেছিলাম। এবারের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি সবার কাছে একটা অনুরোধ করব। সিলেটে শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের পাশেই তার কবরটি অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে। সালমানের মামা আছে সিলেটে। তিনি যদি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেখানকার কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে কবরটি সুন্দরভাবে বাঁধাই করেন তবে তার অনেক ভক্ত খুব খুশি হবে। তার কবর জিয়ারত করে দোয়া করতে পারবে। আমাদের দেখে আগ্রহ পেয়েছিল শাবনাজ, চিত্রনায়িকা

সালমান যে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমাটি দিয়ে নায়ক হন, সেটি আমার আর নাঈমের করার কথা ছিল। পরিচালক সোহান ভাই আমাকে এই সিনেমার জন্য কিছু টাকাও দিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের ‘চাঁদনী’ সুপার হিট হয়। তখন কপিরাইট নিয়ে খুব তোলপাড় হচ্ছিল। আমাদের নিয়ে অযথা তুলনা হবে ভেবে আমরা সিনেমাটি আর করিনি। তখন সোহান ভাই নতুন মুখ হিসেবে সালমান আর মৌসুমীকে ব্রেক দেন। যেদিন তাদের শ্যুটিং শুরু হয় সেদিন আমার আর নাঈমের ‘চোখে চোখে’ সিনেমার গানের শ্যুটিং চলছিল এফডিসিতে।

সোহান ভাই নিজেই এসে বললেন, তোমরা যেহেতু কাজ করলে না নতুন মুখ নিয়ে কাজ শুরু করছি আজ। আমরা খুব খুশি হয়ে বললাম, আমরা অবশ্যই তাদের স্বাগত জানাতে আসব। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে আমরা গেলাম, সেই প্রথম দেখা সালমান ও মৌসুমীর সঙ্গে। তখন বছরে ১২০টার মতো সিনেমা হতো। এত সিনেমা তো আমি একা করতে পারব না। দুটি শিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়ে এসেছে দেখে খুব ভালো লাগল। এর মধ্যে আমার আর নাঈমের বিয়ে হয়। তারপর আমি সালমানের সঙ্গে আঞ্জুমান, মায়ের অধিকার ও আশা ভালোবাসা তিনটি সিনেমার নায়িকা হই। তাই সে আমাকে ভাবী বলে ডাকত।

তাছাড়া ক্যারিয়ারেও আমি তার সিনিয়র। সে আমাকে বলত, তোমাদের দেখেই সিনেমায় আসার ইচ্ছা হয়। তখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের সিনেমায় কাজ করা ছিল বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সে আমাকে আলাদা সমীহ করত। তার অভিনয়, ফ্যাশন সেন্স নিয়ে তো সবাই কথা বলেন। তার বাইরে সে ছিল ভীষণ মিষ্টি একটা ছেলে। তার স্ত্রী সামিরার সঙ্গেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সালমানের চলে যাওয়া আজও মেনে নিতে পারি না। যে যেভাবেই চলে যাক, আল্লাহ তার ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে যেন জান্নাত নসিব করেন সেই দোয়া করি। তাকে কোনোদিন ভোলা যাবে না মৌসুমী, চিত্রনায়িকা

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে আমি আর সালমান চলচ্চিত্রে আসি। কিন্তু সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা ছোটবেলায় একসঙ্গে খুলনায় বড় হয়েছি। সেই রসায়নই হয়তো পর্দায় ধরা পড়েছিল। তাই আমাদের জুটি তুমুল জনপ্রিয় হয়। এরপর অনেক নির্মাতাই আমাদের নিয়ে সিনেমা করতে আগ্রহী হন। ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’ ও ‘স্নেহ’ মুভিগুলোতে আমরা কাজ করেছি।

সালমান আর আমার সম্পর্ক গভীর ছিল। অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আমরা শেয়ার করতাম, যা কাউকে বলতে পারতাম না। আমার জ্বর হলে ওর ভালো লাগত না, ওর কোনো অসুখ হলে আমার না। আমাদের আত্মার একটা টান ছিল। দেখা গেল, জ্বরের কারণে আমি শ্যুটিংয়ে যেতে পারিনি, পরিচালকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেখা করতে চলে আসত। ওর কোনো ভালো হলে আমার ভালো লাগত, ওর খারাপ হলে আমার খারাপ লাগত। এমনই ছিল আমাদের অনুভূতি। সে এমন একটা ছেলে, এমন একজন শিল্পী যাকে কোনোদিন ভোলা যাবে না। সালমানপ্রেমীরাও তাকে ভুলতে পারবে না। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমরা যেন তাকে তার ভালো কাজগুলোর মধ্যে আজীবন মনে রাখি সেই প্রত্যাশা রইল।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন