আকাশে চোখ মেললেই ঘুড়ির লড়াইয়ের দৃশ্য! অন্য সময় তাদের দেখা মেলা ভার। হালের নেটপ্রেমী কিংবা স্মার্টফোনে বুঁদ হওয়া তরুণ প্রজন্মকে মাঠে ফেরাতে দারুণ কাজ করছে ঘুড়ি। গ্রাম বা শহরে এখন ঘুড়ি ওড়ানো খেলা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে।
শিশুরা বড় হচ্ছে খাঁচার মধ্যে। ঘরে বসে শহুরে শিশুরা কম্পিউটার বা ভিডিও গেইম খেলে সময় কাটায়। যারা মাঠে যায়; তারা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে। গ্রামীণ শিশুদের মধ্যেও ক্রিকেট খেলার জোয়ার বয়ে গেছে। তবে ঘুড়ি ওড়ানো খেলা একেবারে হারিয়ে গেছে। একসময় এ দেশের ছেলেপুলেরা প্রচুর ঘুড়ি ওড়াতো। শরৎ, হেমন্তের বিকেলের আকাশ ছেয়ে যেত ঘুড়িতে।
আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াত নানা রঙের ঘুড়ি। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি কত রঙের ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে যেত! দেখে মনে হতো, নানা রঙের মেলা বসেছে আকাশজুড়ে। কোনো ঘুড়ি কাটা গেলে মনে হতো রঙের মেলা থেকে যেন একটি রং খসে পড়ল। একসময় ঘুড়ি ওড়ানো আর ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতার রেওয়াজ ছিল। যা এখন প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে পৌষ সংক্রান্তিতে এখনো কোথাও কোথাও ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব হয়ে থাকে।
‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা। আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি, তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।’ সুফিয়া কামালের লেখা ‘আজিকার শিশু’ কবিতা মনে করিয়ে দেয় শৈশবে ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দময় স্মৃতি। করোনাভাইরাসের লকডাউনে অনেকটাই ফিরেছে ঘুড়ি ওড়ানো সেই বিকেল। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোররা যেমন ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তেমনই অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বড়রাও ঘুড়ি উড়ানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এখন বিকেল হলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকাংশ ভবনের ছাদ এবং গ্রাম-গঞ্জের মাঠে-ময়দানে দেখা মিলছে ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব।
ঘুড়ি এক প্রকারের হাল্কা খেলনা, যা সুতা টেনে আকাশে ওড়ানো হয়। পাতলা কাগজের সঙ্গে বাঁশ থেকে বানানো চিকন কঞ্চি লাগিয়ে সাধারণত ঘুড়ি তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন উপাদান ও নকশার ঘুড়ি রয়েছে। বিশ্বজুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। বহু দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ঘুড়ি ওড়ানো একটি অবসর বিনোদন। বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব পালিত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকর্মা পূজার দিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা রয়েছে।
ঘুড়ি উদ্ভাবন এবং ওড়ানোর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। কিংবদন্তি আছে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসে ঘুড়ি উদ্ভাবন হয়। গ্রিসের বিজ্ঞানী আর্চিটাস ঘুড়ি উদ্ভাবন করেন। এরও বহু যুগ পূর্বে এশিয়া মহাদেশের লোকেরা ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপারে দক্ষ ছিল। চীন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়ায় ঘুড়ি ওড়ানো খেলার প্রচলন রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যে, প্রায় ২,৮০০ বছর পূর্বে চীন দেশে ঘুড়ির সর্বপ্রথম উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ইউরোপে ঘুড়ি খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১,৬০০ বছর পূর্বে।
ঘুড়িপ্রেমীদের তথ্যমতে, শীতের শেষে বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যখন জেগে উঠতো, তখন গ্রামের বিলগুলোতে চলতো ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা। প্রত্যেক কিশোরের হাতে থাকতো লাটাই ও সুতা। আকাশে উড়তো বিচিত্র নামের রঙিন ঘুড়ি।
তার সঙ্গে প্লাস্টিকের বস্তা থেকে তোলা পাতলা সুতা কিংবা বেত ও বাঁশের পাতলা চ্যাটা একটি ধনুকের মতো ছড়ের সঙ্গে বিশেষভাবে বেঁধে ঘুড়িতে জুড়ে দিলে উড়ন্ত ঘুড়ি থেকে সুরেলা শব্দ শোনা যেতো। একে ডাক ঘুড়ি বা বেনা ঘুড়ি বলা হতো।
ইদানিং অনেকেই বাড়ির ছাদে নিজেদের ঘুড়ি উড়ানোর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এসব ছবি দেখে অনেকেই ফিরে যাচ্ছে সেই পুরোনো স্মৃতির দিকে। এখনকার চিত্র দেখলে মনে হচ্ছে, সেই ঘুড়ি ওড়ানো বিকেলগুলো হয়তো আজ আবারও ফিরে এসেছে। গ্রামে-গঞ্জে এখন ঘুড়ি উড়ানোর সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শিশু-কিশোররা উড়াচ্ছে ঘুড়ি। বাতাসে দুলতে দুলতে ভূপাতিতও হয় ঘুড়িগুলো।
শিশু-কিশোররা রাতে উড়ানোর জন্য ঘুড়িতে যুক্ত করেছে ব্যাটারি চালিত বাতি, যা রাতে উড়ানো ঘুড়িতে জ্বলছে। বড়দের কেউ কেউ ঘুড়ি বানাতে পারলেও শিশু-কিশোররা বেশিরভাগই ঘুড়ি কিনে উড়িয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুড়ি তৈরির ধুম পড়েছে। এ কারণে গ্রামের ঘুড়ি তৈরিতে যুবকরা ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের কাছেই এখন মিলছে ঘুড়ি। সাধারণত যেকোনো ডিজাইনের একটি ঘুড়ির দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। তারা জানান, এখন প্রচুর পরিমাণে ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, করোনাভাইরাসে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোররা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তাই বিকেলে একটু আনন্দ পেতেই তারা ঘুড়ি উড়াতে মেতে উঠছে।