‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’
১৯৭১ সালে বন্দীজীবন থেকে দেশের মাটিতে পা রেখে বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রবি ঠাকুর দেখে যাও, আমার বাঙালি মানুষ হয়েছে।’ আজ পঞ্চাশ বছর পর রবীন্দ্রনাথের সেই বক্তব্যের সঠিকতাই প্রমাণিত হলো না কি? যখন আমরা দেখছি করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ার খবরে বাড়িওয়ালাসহ পাড়া-প্রতিবেশী তাৎক্ষণিক বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়াকে জোর করে বের করে দিতে চায়, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ সবাইকে পুড়িয়ে মারতে চায়; যখন বৃদ্ধা মাকে সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে ‘মা আমরা আসছি’ বলে পালিয়ে যায়; বাসযাত্রীরা অসুস্থ সঙ্গীকে বাস থেকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায়; হাসপাতালেও করোনা আক্রান্তদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়-তখন বাঙালি ‘মানুষ’ হয় কি করে? আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডাক্তারের জন্য ক্রয় করে নকল পিপিই কিন্তু বিচার হয় না।
সঠিক পিপিই এলেও অশুভ উদ্দেশ্যে তা দেয়া হয় না। আক্রান্ত হয় ডাক্তার নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী। এমন আছে হাজারো ঘটনা-সমস্ত অধিদপ্তর, দপ্তর, মন্ত্রণালয়সহ দেশব্যাপী। অপকর্ম আছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ মাদ্রাসায়ও।
এসব আচরণতো মানুষের হতে পারে না। আর মানুষ হতে হলে যে শিক্ষার প্রয়োজন আক্ষরিক ও মানবিক অর্থে তার কোনো অবশিষ্ট নেই দেশে। তাই টিভি পর্দায় দেখা যাচ্ছে ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের আর্তনাদ, তাদের হাহাকার, তাদের প্রশ্ন-শ্রমিক কল্যাণের নামে যে অর্থ ১২ বছর ধরে চাঁদা হিসেবে জনগণ থেকে আদায় করা হয়েছিল-তা কোথায়? পরিবহন শ্রমিকের এই দুর্দিনে সেই সদা হাস্যমুখ মন্ত্রী শ্রমিক নেতা, পাতি নেতারাই বা কোথায়?
তাই ৩০ লাখ ছাত্র শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই দেশে খুলনার জুট মিলের শ্রমিকদের বেতন না পাওয়ার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক আমলাকে একদিন বলতে শোনা গেল-কেউ কেউ তো মরবেই-এ নিয়ে আপনাদের এত হৈ চৈ? -এক টিভি চ্যানেলের টকশোতে শ্রদ্ধেয় অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালকে রাগত স্বরেই বলতে দেখা গেল তাকে। আর গত আমন ধান কেনার মৌসুমে কৃষক যখন ধান বিক্রিতে ন্যায্য দাম পাচ্ছিলেন না-তখন সরকারের উচ্চপদস্থ এক অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন-‘দেশের মানুষের খ্যাদ্যাভাস বদলেছে; তাই কৃষকের এত ধান উৎপাদন করার দরকার নেই। এত ধান সরকার কিভাবে কিনবে?এইতো জ্ঞান-বিবেক আমাদের অধিকাংশ এলিট শ্রেণির কর্মকর্তা; অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের। এমন অমানুষরাইতো সকল পর্যায়ের উচ্চাসনে বসে আছেন-রবীন্দ্রনাথের সেই কথাই আবার বলতে হয়-‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ আছে কিন্তু তা আর কতজন? সমাজ তাদের বোকা বলে।
সারা বিশ্বেতো অমানুষের সংখ্যাই বেশি। শুধু নিজেরা ভালো থাকার জন্য এরা চিন্তা করে- কিভাবে বিশ্বকে পদানত করে রাখা যায়? এরা মিসাইল বানায়, ভারী ভারী অস্ত্র, কামান গোলা বানায় ব্যবাসয়ীক স্বার্থে। সকল অর্থ শ্রম ব্যয় করে বিশ্বের সকল দেশকে পদানত করার জন্য। আজ করোনাভাইরাসের ‘কল্যাণে’ তারাই আজ নিজের দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারছে না। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে। ২৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৫ জন আর মৃত্যুবরণ করেছে ৫৯ হাজার ২৬৬ জন। প্রতিদিনই যা বাড়ছে। পত্র পত্রিকা বলছে দুই দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিদের নিহতের চেয়ে এ সংখ্যা বেশি। তা ছিল ৫৮ হাজার ২২০ জন। আর এককালের সাম্রাজ্যবাদী মুসলীনির দেশ ইতালি-তাদের মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার ৩০৯ জন। সেকালের উপনিবেশিক ফ্রান্সে-২৪ হাজার, ব্রিটেনে ২২ হাজার, আর সেই হিটলারের জার্মানিতে সাত হাজার। আরও অন্যান্য দেশে আছে।
এইসব সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে- তারাই জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও কর্মের যোগানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং করোনা ভাইরাসকে জয় করেছে। কিউবা, ভিয়েতনাম, লাওস, কোরিয়া এদের মধ্যে অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পঁচাত্তর বছর পর আজ করোনা ভাইরাস বিশ্বকে এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, একা একা ভালো থাকতে চাওয়া অপরাধ। তা ব্যক্তি হিসেবে যেমন সত্য, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও তাই। ইয়েমেনের শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা খাদ্যের অভাবে কংকালসার হচ্ছে সৌদি আরবের অমানবিক আচরণে যুদ্ধংদেহী মনোভাবে। সিরিয়ায় যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা হয়েছে-ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা-ধ্বংস হচ্ছে দেশ। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন রাষ্ট্র ব্রিটেনের সহায়তায় মিথ্যা অজুহাতে ইরাক ধ্বংস করছে। ইরাকের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে। এরা মানবতার শত্রু। বিশ্ববিবেককে এরা দয়ামায়াহীন করে ফেলেছে। এমনকি প্রকৃতির ওপর নির্দয় আচরণ করেছে। প্রকৃতি-পরিবেশবান্ধব বিশ্ব আন্দোলনকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, অনুদান বন্ধ করেছে। সম্প্রতি তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তাদের দেয়া অর্থ বন্ধ করে দিয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রথমে চীনে শুরু হলেও মৃতের সংখ্যা ৪,৬৪৩ জন এবং আক্রান্ত হয়েছিল ৮৪,৩৭৩।
অথচ সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা সেখানে একজনও আক্রান্ত হয়নি। ভিয়েতনামে করোনায় মৃত্যু নেই। সুস্থ হয়ে উঠেছে সব মানুষ। তারা ৪ লাখ ৪০ হাজার পিপিই পাঠিয়েছে তাদের সেই শত্রু দেশ আমেরিকায়। বাংলাদেশের পরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমাজতান্ত্রিক দেশ লাওসের স্বাস্থ্য পরিষেবা ভালো। সেই কারণেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৯। ভারতের কেরালা রাজ্যে কমিউনিস্ট শাসিত-সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী আম্মা উপাধি পেয়েছেন। তারা করোনাকে বলিষ্ঠভাবে দমন করেছেন। অর্থ্যাৎ যেসব দেশ সব মানুষের জন্য সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়-তারা সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও কর্মের নিশ্চয়তা দেয়-তারাই করোনাকে প্রতিহত করতে পেরেছে।
বিশ্বের অধিকাংশ আত্মভরি মানুষ-যা তাদের জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে নাই; অদৃশ্য ভাইরাস তা ভাবতে শেখাচ্ছে।
তাই দেখা যাচ্ছে, ভারতের সরকার যারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিনা নোটিশে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলেছিল, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা মোচনে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে চায়নি-সেই দেশের সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে করোনায় খাদ্য সংকট মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিলেন।
অথচ কয়েক মাস আগেই গাড়ি ভর্তি পেঁয়াজ বর্ডারে আটকিয়ে দিয়েছিলেন-একটু ইনফরম করার প্রয়োজন বোধ করেননি। সৌজন্য বোধটুকুও প্রদর্শন করেনি। আবার তিস্তা সমস্যার সমাধান না করে শুষ্ক মৌসুমে মানুষকে শুকিয়ে মারছেন আবার বর্ষাকালে সব গেট খুলে দিয়ে মানুষের ঘর-বাড়ি ফসল পানির তোড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
আমাদের দেশ বাংলাদেশে বসবাসরত উপরতলার মানুষ যারা এতোদিন শুধু নিজেদের সুখে থাকার চিন্তায় ঘুষ, দুর্নীতি, খুন, ব্যাংকের টাকা লুট, ক্যাসিনো বাণিজ্য, মদ পাচারসহ এমন ধরনের সমস্ত রকম অপকর্ম, ত্রাণের মালামাল লুটের চেষ্টার মতো অন্যায় করেছে এবং মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকায় বেগম পাড়ায় বেহেস্ত বানিয়েছে- তারা এখন কোথায় যাবে, নরক ছাড়া?
অনেক রূঢ় শোনালেও করোনাভাইরাসের শিক্ষা যদি মানুষকে মানুষ করতে পারে- তাহলে মন্দ কি? করোনাভাইরাস আজ সারা বিশ্বকে মাথার উপর তুলে আছাড় মারছে-যদিও তার মাথামুণ্ড কিছুই নেই। আছে শুধু RNA. আর এর জিনোম সিকোয়েন্স A-U, G-C অর্থাৎ Adenine-urcil; Gruanine-cytosine- এইসব হলো নাইট্রোজেনযুক্ত ক্ষার (Nitrogenous base)। RNA-এর আবার রকমফের আছে। যেমন: 1) t-RNA (transfer RNA) 2) r-RNA (Ribosomal RNA) 3) m-RNA (Messenger RNA) 4) G-RNA (Genetic RNA)। RNA-এর জটিলতা বোঝার জন্য এই চার প্রকারের ইল্লেখ করা হলো। মতান্তরে আরো আছে। RNA এক সূত্রক অর্থাৎ এক সুতার। এই সুতা পাঁচ কার্বনের রাইবোজ সুগার ও ফসফেটের তৈরি। RNA অর্থ Ribonuclic Acid| DNA দ্বি সূত্রক। DNA হচ্ছে De-oxy Ribonuclic Acid। একটি অক্সিজেন অনু কম সেখানে। DNA সবসময় পেচিয়ে থাকে। RNA এক সুতার। মাঝে মধ্যে Adenine-urcil- কে পেলে জোড় বেঁধে A-U ফাঁসের আকার ধারণ করে।
এইটুকু চেহারা নিয়েই সে ভ্রমণ করছে ইতালি, চীন, আমেরিকাসহ কত দেশ, কত সাম্রাজ্য। আর ঘন ঘন হচ্ছে পরিবর্তিত। যা সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য- যা ছিল সার্স, মার্স, ইবোলা এবং বর্তমানে করোনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন- সে বিবর্তিত হয়েছে নাকি ১১ বার। এই পরিবর্তনই প্রমাণ করে বিবর্তনবাদ। কোনো প্রজাতি কোনো অপরিবর্তনশীল সত্ত্বা নয়, এটি পরিবর্তিত হয়। তাই পৃথিবীর সকল জীব পরিবর্তনের মাধ্যমে, বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। এতে সময় লেগেছে ৩.৬ বিলিয়ন বছর। কোনো জীবই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। বিবর্তনের বিরোধীরা যাই বলুক।
(বি.দ্র: করোনাভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় না। হাঁচি কাশির সময়ে বের হয়ে বড় জোর চার ফিট দূরে যেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তাই মরণাপন্ন ব্যক্তির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ না করে, তাকে সিঁড়িতে ফেলে না দিয়ে, বিছানা থেকে ৪-৫ হাত দূরে থেকে কথা বলতে পারেন, বড় পলিথিনের ব্যাগ কেটে নাক মুখ ঢেকে শেষ পানি দিতে পারেন। তারপর আপনারা কাপড় বদলিয়ে সাবান পানিতে ধুতে পারেন। দাফনের সময়ও থাকতে পারেন। কারণ বিজ্ঞানিরা বলেন মৃত ব্যক্তির দেহে ৩ ঘণ্টার বেশি এই ভাইরাস বাঁচতে পারে না। বিষয়গুলো জনগণকে জানানো প্রয়োজন। আর সবসময় অন্যের থেকে ৪-৫ ফিট দূরে করতে হবে। একেই বলে শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব।)
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক একতা ও শিক্ষাবার্তা
সাবেক অধ্যাপক, নডরডেম কলেজ