রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের বিশেষ যত্ন এবং করণীয়

রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মতান্ত্রিক ওষুধ সেবন, খাবার গ্রহণের মাত্রা, ব্যায়াম, ডায়াবেটিস পরীক্ষার নিয়মসহ সমগ্র জীবনযাত্রার পরিবর্তন করতে হয়। অল্প সময়ে জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে না পেরে অনেকেই পড়েন নানা সমস্যায়।

ডায়াবেটিসের কোন ঔষধ কখন খাবেন?

১. ডায়াবেটিসের যেসব ঔষধ নাস্তার আগে খেতে হয়, সেগুলো ইফতারের শুরুতে খেয়ে ইফতার শুরু করবেন। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের মতো ১০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করা যাবে না।

২. ইনসুলিন নিয়েই ইফতার খেতে বসতে হবে। এক্ষেত্রেও নরমাল ইনসুলিনগুলোর ক্ষেত্রে যে ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়, সেটা করা যাবে না। আর আধুনিক ইনসুলিনগুলোতে তো অপেক্ষা করাই লাগে না, সাথে সাথেই খাওয়া যায়।

৩. সেহরীতে ডায়াবেটিসের ঔষধ এবং ইনসুলিনের waiting period ঠিকই বজায় রাখবেন। নরমাল ইনসুলিনগুলো সেহরীর ২০ মিনিট আগে এবং আধুনিক ইনসুলিনগুলো সেহরী খাবার ৫ মিনিট আগে নিবেন।

৪. থাইরয়েডের ঔষধ – Thyrox/Thyrin/Thyronor ইত্যাদি সেহরীর অন্তত আধা ঘন্টা আগে খাবেন।

৫. প্রেশারের ঔষধ- সকালেরগুলো সেহরীতে এবং রাতেরগুলো ইফতারে খাবেন। তবে আপনার প্রেশার যদি ঔষধ খেয়ে খুব স্বাভাবিক থাকে (১১০/৭০) তবে সেহরীতে ঔষধের ডোজ একটু কমানো লাগতে পারে। কারণ ১৪ ঘন্টার বেশী আপনি পানি খেতে পারবেন না। ফলে ঔষধের ডোজ না কমালে, আপনার প্রেশার কমে যেতে পারে।

৬. গ্যাসের ওষুধ – সেহরীর ১৫-২০ মিনিট আগে খাবেন। ইফতারে এই অপেক্ষাটা কিন্তু করা যাবে না। গ্যাসের বড়ি খেলেও সাথে সাথেই ইফতার শুরু করবেন।

ডায়াবেটিস কখন মাপবেন?

১. বিকেল তিনটা থেকে চারটার মধ্যে একবার মাপবেন। এই সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে, আপনার সেহরীর ঔষধ এবং ইনসুলিনের ডোজ adjust করতে হবে।

২. আরেকবার মাপবেন, ইফতারের দুই ঘন্টা পর। এই সময়ের সুগারের মাত্রা দেখে, আপনার ইফতারে ডায়াবেটিসের ঔষধ এবং ইনসুলিন adjust করতে হবে।

৩. আঙ্গুল থেকে রক্ত নিয়ে, গ্লুকোমিটারে সুগার মাপলে, রোজার কোন ক্ষতি হবে না।

কখন রোজা ভেঙে ফেলবেন?

১. খুব অসুস্থ বোধ করলে।

২. বেলা তিনটা-চারটার সময় সুগারের মাত্রা ৩.৫ এর কম পেলে।

৩. সেহরী করতে না পারলে।

রোজায় খাওয়া দাওয়ার নিয়ম কি?

১. সেহরীর শেষ সময়ের কাছাকাছি সময়ে খাবেন, বেশী আগে না।

২. দৈনিক মোট ক্যালরীর পরিমান একই থাকবে। অর্থাৎ এখন ১৬০০ ক্যালরীর খাবার খেলে, রোজাতেও একই রাখবেন।

৩. ইফতার থেকে সেহরী পর্যন্ত প্রচুর পানি এবং তরল খাবেন। যেমনঃ- ডাবের পানি, শরবৎ (কম চিনিযুক্ত বা চিনিবিহীন), দুধ, টক দইয়ের লাচ্ছি, ডাল ইত্যাদি।

৪. ইফতারে ভাজাপোড়া এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাবেন।

৫. সেহরী এবং ইফতারে আঁশযুক্ত খাবার বেশী খাবেন। যেমনঃ- ভাত, রুটি, সব্জি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ফলমূল, সালাদ ইত্যাদি।

রোজা রেখে ব্যায়াম করার নিয়ম কি?

১. ইফতারের পর বা তারাবীহ নামাজের পর বা রাতের খাবারের পর ব্যায়াম করবেন বা হাঁটবেন – দিনের অন্য কোন সময় নয়।

২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং ২০ রাকাত তারাবীহ নামাজ যারা পড়বেন, তাদের আর অতিরিক্ত কোন ব্যায়াম বা হাঁটার দরকার নেই।

রোজা রেখেও কোন কোন ঔষধ ব্যবহার করতে পারবেন?

১. চোখ ও কানের ড্রপ।

২. চামড়ায় লাগানোর ক্রীম।

৩. সাপোজিটরী।

৪. অক্সিজেন।

৫. ইনজেকশন (তবে শিরাপথে দেয়া পুষ্টির ইনজেকশন নয়)।

৬. জিহবার নীচে দেবার ট্যাবলেট বা স্প্রে (হার্টের ব্যথা উঠলে)।

ডায়াবেটিস অবস্থায় রোজা রাখা কাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরুৎসাহিত করা হয়?

১. যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত (সুগার ১৫ এর বেশী থাকে)।

২. গুরুতর কিডনী সমস্যা থাকলে।

৩. চোখের রেটিনায় গুরুতর সমস্যা থাকলে।

৪. নিউরোপ্যাথি বা নার্ভে সমস্যা থাকলে।

৫. যারা হাইপো হলে বা সুগার কমে গেলেও বুঝতে পারেন না।

৬. যাদের হার্টে গুরুতর সমস্যা।

৭. গর্ভবতী। ৮. ক্যান্সারের রোগী।

৯. যাদের তীব্র পেপটিক আলসার। ১০. গুরুতর এজমা রোগী।

১১. লিভারে সমস্যা থাকলে।

১২১. গুরুতর মানসিক সমস্যা থাকলে।

এছাড়া ও আপনার চিকিৎসকের পরামর্শই আপনার জন্য সেরা, যে চিকিৎসক আপনার ডায়াবেটিসকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং যিনি শুধু ঔষধের বাইরেও আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন – আপনার পেশা, Lifestyle, অভ্যেস, বদভ্যেস, মানসিক চাপ, খাবার মেন্যু ইত্যাদি৷ কারণ ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা শুধু আপনার উপসর্গের উপর নয়, বরং আপনার জীবন যাত্রার উপরও নির্ভর করে।

ডায়াবেটিস রাখুন নিয়ন্ত্রণে, সুস্থ্য থাকুন দেহ-মনে।

পরামর্শ দিয়েছেন – ডা: এজাজ বারী চৌধুরী, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, সিটি হাসপাতাল, লালমাটিয়া, ঢাকা।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন