ভাইরাস প্রতিরোধে খান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার

মানুষের শরীরের কোষগুলোকে অক্সিজেন, ভাইরাস ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলে। এসব ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবার জন্যে প্রতিরোধক দরকার, যার নাম অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। প্রয়োজনীয় পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট না থাকলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। যার কারণে কোষের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মুক্ত র‌্যাডিকাল ঘুরে বেরিয়ে কোষের ক্ষতি করে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চিকিৎসকরা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। রোগ প্রতিরোধে আমাদের শরীরের ভিতরে অঙ্গ-পতঙ্গগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবদেহের সার্বিক গড়ন-গঠনপ্রণালী এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরের কর্মধারাকে শরীরকে রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করে এবং বাইরের রোগ জীবাণুর আক্রমণ নষ্ট করে দেয়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন সঠিকভাবে কাজ করে, তখন সেটা বিভিন্ন বিপদ আগে থেকেই বুঝতে পারে, যাকে প্যাথোজেন বলে এবং প্যাথোজেনের মধ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী অন্যতম। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরের সুস্থ টিস্যু থেকে এদেরকে আলাদা করে। রোগ প্রতিরোধে ভিতরের অঙ্গ-পতঙ্গগুলোর উপাদান যেভাবে কাজ করে তার উপর আলোকপাত করা হলো।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অন্যতম উপাদান

লসিকা গ্রন্থি: ছোটো শিম আকৃতির এই অঙ্গ নির্দিষ্ট কিছু কোষ উৎপাদন করে এবং সঞ্চয় করে এবং এই কোষেরা শরীরকে জীবাণু ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। লসিকা গ্রন্থি লিম্ফাটিক সিস্টেমের অন্তর্গত এবং অস্থি মজ্জা, প্লিহা, থাইমাস এবং লসিকা গ্রন্থি নিয়ে তৈরি হয়। ‘লিম্ফ’ লসিকাগ্রন্থির ভেতরের স্বচ্ছ জলীয়, যা কোষগুলোকে শরীরের বিভিন্ন অংশে বহন করে নিয়ে যায়।

প্লিহা: প্লিহা সর্ববৃহৎ লিম্ফাটিক অঙ্গ, যা শরীরের বাঁদিকে পাকস্থলীর ওপরে ও পাঁজরের নীচে অবস্থিত। প্লীহা, সংক্রমণ বা রোগব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করা রক্তকণিকাকে ধারণ করার পাশাপাশি শরীরে রক্তের পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরনো বা ধ্বংসপ্রাপ্ত রক্তকোষকে সরিয়ে দেয়।

অস্থিমজ্জা: হাড়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হলুদ রঙের টিস্যু, যা শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে। হাড়ের মধ্যস্থ নরম ছিদ্রবহুল এই টিস্যু অপরিণত কোষ ধারণ করে যাকে স্টেম কোষ বলা হয়, যেমন নিতম্ব ও ঊরুর হাড়।

লিম্ফোসাইটসঃ এই ক্ষুদ্র শ্বেত রক্তকণিকা শরীরকে রোগব্যাধির হাত থেকে বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লিম্ফোসাইটস দুই ধরণের, যথা বি-কোষ যা ব্যাকটেরিয়া ও শরীরে উৎপন্ন টক্সিনকে আক্রমণকারী অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং টি-কোষ, যা সংক্রামিত ও ক্ষয়প্রাপ্ত কোষদের ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

থাইমাস: এই ক্ষুদ্র অঙ্গে টি-কোষ পরিণতি প্রাপ্ত হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রায়-উপেক্ষিত এই অঙ্গ বক্ষদেশের হাড়ের অন্তরালে অবস্থিত এবং অ্যান্টিবডির উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে।

শ্বেত রক্তকণিকা: রোগব্যাধির সঙ্গে লড়াই করা এই শ্বেত রক্তকণিকা প্যাথোগেনসকে চিহ্নিত করে এবং যাকে সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বিতীয় বাহু বলা হয়। শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যার গণনা বেড়ে যাওয়াকে লিউকোসাইটোসেস হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার

প্রধান অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো হল বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, সি, ই, লাইকোপেন, লুটেইন সেলেনিয়াম ইত্যাদি। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবারগুলো প্রতিদিন রাখতে পারেন।

বিটা ক্যারোটিন: বিটা ক্যারোটিন শরীরে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম গড়তে এটা খুবই দরকারি। উজ্জ্বল রঙের ফল ও সবজিতে এটা পাওয়া যায়। যেমন খেজুর, গাজর, পালংশাক, আলু, আম, ডাল, ব্রকলি ইত্যাদি।

ভিটামিন এ: ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে ভিটামিন এ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন এ পাওয়া যায় যেসব খাবারে- ডিম, কলিজা, দুধজাতীয় খাবার। এছাড়া মিষ্টি আলু, সবুজ শাকসবজি, লাল মরিচ, গাজর, লাউ, ফুটি/খরমুজ, পেঁপে, আম, লেটুস, গুঁড়া মরিচ, এপ্রিকট ইত্যাদিতে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি৬: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন বি৬। চিকেন, স্যামন, টুনা, সবুজ শাকসবজি, চানা ডালে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি৬ রয়েছে।

ভিটামিন সি: যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো নয় এবং মাঝে মধ্যেই রোগে ভোগেন তারা নিয়মিত ভিটামিন সি খেলে কয়েক দিনের মধ্যেই পরিবর্তন বোঝা যায়। ভিটামিন সি ভরপুর এমন খাবারের তালিকায় রয়েছে- কমলালেবু, আঙুর, স্ট্রবেরি, বেলপেপার, পালংশাক, ব্রকলি, পাতিলেবু।

ভিটামিন ডি: ডিম, পনির, টোফু ও মাশরুম। সূর্যের আলো তথা রোদ থেকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।

ভিটামিন ই: ভিটামিন ই শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়ায়। আমন্ড, কাজু, আখরোট, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, বাদাম তেল, বিচিজাতীয় ও ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি।

আমিষ: উচ্চমানের আমিষজাতীয় খাবার যেমন ডিম, মুরগির মাংস ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।

চা: গ্রিন-টি, লাল চায়ে এল-থেনিন এবং ইজিসিজি নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা আমাদের শরীরে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনেক যৌগ তৈরি করে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।

প্রোবায়োটিকস: প্রোবায়োটিকস শ্বাসযন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্র সংক্রমণের ঝুঁকি প্রতিরোধ করে। টকদই ও দুধ থেকে প্রস্তুত খাবার এর আদর্শ উৎস। এছাড়া সব ধরনের শস্যদানা, কলা, পেঁয়াজ, রসুন, অ্যাসপারাগাস ও শিম। শাকসবজি, ফল, বাদামজাতীয় খাবার শরীরে নিউটোভ্যাক্স ভ্যাকসিনের অ্যান্টিবডি প্রক্রিয়াকে উন্নত করে, যা স্টেপটোকোক্কাস নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের খুব ভালো কাজ পেতে হলে খাবার রান্নার সময় অতিরিক্ত তাপে বা দীর্ঘ সময় রান্না না করে স্বল্প তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে। ফলমূল-শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। যাতে করে জীবাণুমুক্ত থাকে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদানসমূহ প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে খেতে হবে। একই সঙ্গে প্রাণিজ আমিষ, বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংস খাওয়া কমিয়ে আনা। সুস্বাস্থ্য অটুট রাখতে প্রতিদিন পরিমিত ব্যায়াম করা জরুরি। জীবনের শৃঙ্খলও দীর্ঘায়ু লাভের সহায়কে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন