বাংলাদেশে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ

সংক্রমণের চলমান ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। রোগতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পরপর চার সপ্তাহ যদি সংক্রমণ দেড়গুণ হারে বাড়তে থাকে, কিংবা একই সময়ে সংক্রমণ হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়তে বাড়তে ধারাবাহিকভাবে ১০-১৫ শতাংশে উঠে যায়, তবে সে পরিস্থিতিকে রোগটির দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। সে হিসাবে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে গতকাল রবিবার পর্যন্ত করোনার সংক্রমণের হার ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। পাশাপাশি সংক্রমণ হার ৫ থেকে বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ সময় নতুন শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯০৮ জন রোগী, যা গত ৯ মাস (এক দিন কম) বা ২৬৯ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্ত হার গত ৭ মাস ১ দিন বা ২১১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ১৮ শতাংশে উঠে এসেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৩৫ জন।

সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলে সতর্ক করে দিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সচেতন ও সতর্ক না হলে পরিস্থিতি সামনে বিপজ্জনক হয়ে দেখা দিতে পারে। অবস্থা কোনদিকে যায় বলা যাচ্ছে না।

গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মহামারীর নতুন ধাক্কা সামলাতে ও মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী আগের নির্দেশনাগুলো পালন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কেউ যেন মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে না যায়, সেই নির্দেশ দিয়ে মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উন্মুক্ত জায়গায় দলীয় কর্মসূচি পালনের ওপর জোর দেন তিনি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে সতর্ক করে দিয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে সংক্রমণের যে ধারা, এখন এটাকে দ্বিতীয় ধাপ বা দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। কারণ গত ১০-১৫ দিন ধরে যে হারে বাড়ছে, তাতে দ্বিতীয় ধাপ তো বটেই। প্রথম ধাপে যেভাবে বাড়তে শুরু করেছিল, পরে কমেছে। আর বাড়েনি। কিন্তু এখন শুধুই বাড়ছে, কমছে না।

দ্বিতীয় ঢেউয়ের সব লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যই আছে : এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পরপর চার সপ্তাহ যদি রোগটি দেড়গুণ হারে বাড়ে, তাহলে বলা যাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আমরা প্রবেশ করেছি। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এ তিন সপ্তাহে দেড়গুণের বেশি সংক্রমণ বেড়েছে। চতুর্থ সপ্তাহ শেষ হবে ৩ এপ্রিল। সে পর্যন্ত যদি এই হার অব্যাহত থাকে, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রবেশ করেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সব লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যই আছে। সংক্রমণ কমছে না। একসময় উত্থান-পতন হতো। এখন শুধুই ঊর্ধ্বমুখী। তবে গত বছর নভেম্বরের মতো যদি কমে যায়, তাহলে বলতে হবে ছোট একটি তরঙ্গ অতিক্রম করল। আর তা না হলে দ্বিতীয় ঢেউ-ই বলতে হবে।

অবশ্য আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সব সূচকই বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সংক্রমণের হার বাড়ছে। সংক্রমণের হার কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, সারা দেশেই বাড়ছে। এর মধ্যে ঢাকায় সংক্রমণ বেশি ঘনীভূত। কারণ এখানে জনসংখ্যা বেশি, আগের চেয়ে বেশি বের হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। আরেকটি সূচক হলো সংক্রমণের সংখ্যা (পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার) ৫ শতাংশের নিচে চলে গিয়েছিল, সেটা যদি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ১০-১১-১২-১৩-১৪ শতাংশ হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলায় যায়।

সংক্রমণের গতি দ্রুত, অবজ্ঞা ও রোগের জটিলতা বেশি : প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের কিছু উদ্বেগজনক পরিবর্তনের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউটা খুব দ্রুত উঠেছে। সংক্রমণের গতিও বেশ দ্রুত। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউটা বেশি ‘অ্যালার্মিং’, মারাত্মক।

দ্বিতীয় ধাপের আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, দ্বিতীয় ধাপে রোগীর জটিলতা বেশি হচ্ছে। রোগী বেশি হলে জটিলতাও বেশি হবে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে করোনা অবজ্ঞা করার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এ প্রবণতা খুব ক্ষতিকর। কারও সর্দি-কাশি হয়েছে, করোনার উপসর্গ আছে, কিন্তু সে পরীক্ষা করছে না। পরে দেখা গেল সে করোনা পজিটিভ ও তার মধ্যেই রোগটির জটিলতা বেশি। পরে সে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে গেল। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। তাই কারও মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিলেই তার পরীক্ষা করা উচিত। যদি করোনা পজিটিভ হয়, তাহলে যেকোনো একজন চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসাধীন থাকলে অন্তত জটিলতা তৈরি হবে না। জটিলতা না হলে হাসপাতালে যেতে হবে না। হাসপাতালে যেতে না হলে আইসিইউ দরকার হবে না। তার মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে দেবে। মৃত্যুর সংখ্যাও কমবে। তা না হলে খুবই বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হবে।

প্রথম দফার তুলনায় এবার জটিল রোগী বেশি বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, এখনকার রোগীগুলো হাসপাতালে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট বেশি হচ্ছে। আগে এতটা খারাপ ছিল না। আগে তরুণ রোগী কম ছিল, এখন তরুণ রোগীও পাচ্ছি। ৩০-৪০ বছরের রোগীও বেশ পাওয়া যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এখন যে রোগী আসছে, তাদের জ¦র কম, কিন্তু হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। জটিল রোগী বেশি আসছে। বেশিরভাগেরই হাই-ফ্লো অক্সিজেন দরকার হচ্ছে। আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক আইসিইউতে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে রোগীর সংখ্যা যেমনই হোক, আইসিইউর ওপর আগের চেয়ে বেশি চাপ পড়ছে।

ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, আগে যেমন বয়স্ক কভিড রোগীর জন্য আইসিইউ বেশি দরকার হতো, এবার মধ্যবয়সের চেয়ে কমবয়সী রোগীদের জন্য আইসিইউ দরকার হচ্ছে। আগে যেমন রোগীদের ১০৩-১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ¦র থাকত। এবার জ¦র সামান্য। কিন্তু হঠাৎ করেই ডায়রিয়া শুরু হচ্ছে, তারপর শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে বিপজ্জনক অবস্থা : আইইডিসিআরে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে সবার জন্য বিপদ আছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এখন যে সংক্রমণের যে ধারা তাতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে। আমরা যদি এখনই স্বাস্থ্যবিধি না মানি, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, সামাজিক অনুষ্ঠান বাদ না দিই, বন্ধ বা সীমিত না করি, মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য না করি, সাধারণ মানুষকে যদি সচেতন করতে না পারি, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় যাবে, তা আমরা জানি না।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যদি সবাই স্বাস্থ্যবিধিটা কঠোরভাবে পালন করতে পারতাম, জনসমাবেশ বন্ধ করতে পারতাম, পর্যটনকেন্দ্র ও খাবার রেস্টুরেন্টগুলোতে কাস্টমার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, তাহলে নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। সবচেয়ে বেশি দরকার ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সতর্কতা। কারণ নিজের জীবন নিজেকে রক্ষা করতে হবে। নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না।

আগের উদ্যোগ কঠোরভাবে পালনের পরামর্শ : দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো উদ্যোগ দরকার কি না জানতে চাইলে ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, দ্বিতীয় ধাপ বা প্রথম ধাপ, সবকিছুরই মূলে স্বাস্থ্যবিধি। প্রথম ধাপে ছিল শুধু স্বাস্থ্যবিধি। দ্বিতীয় ধাপে এর সঙ্গে টিকা যুক্ত হয়েছে। এখন সবাই যদি টিকা দিতে থাকে ও স্বাস্থ্যবিধি মানে, তাহলে একপর্যায়ে সংক্রমণ সংখ্যা কমে যাবে। মৃত্যুর সংখ্যাও কমে যাবে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, মাস্ক ব্যবহার গত তিন-চার দিন ধরে কিছুটা বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। এখনো ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরছে না। সামাজিক দূরত্বও মানা হচ্ছে না।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এক বছর পর এখন পুরো বাংলাদেশ বা গোটা শহর লকডাউন করা যাবে না। এখন কাউন্টার প্রোডাকটিভ, অর্থাৎ টার্গেট করে বেশি সংক্রমিত স্থানগুলোতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সরকারের সহযোগিতা করা, চিকিৎসার ফলোআপ করা এবং অবস্থা খারাপ হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যারা শনাক্ত হবেন, তাদের বয়স যদি ৬০-৬৫ বছরের বেশি হয়, তাদের চিকিৎসা সুবিধাসংবলিত আইসোলেশন সেন্টার বা সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে হবে। সেখানে আইসিইউ না থাকলেও চলবে, কিন্তু অক্সিজেন ও হাই-ফ্লো অক্সিজেন থাকতে হবে। খারাপ হলে সেখান থেকে আইসিইউতে স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমাতে হলে একটি সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন এবং এগুলোর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। এভাবে সংক্রমণ কমানো সম্ভব। আর সংক্রমণের সংখ্যা কমালে মৃত্যু সংখ্যাও কমবে। যারা মৃদু সংক্রমিত হয়েছে, তাদের ফলোআপ করতে হবে। এভাবে রোগটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে এখনো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন