স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলাদিনের চেরাগ হিসেবে পরিচিত আবদুল মালেক (৬৩)। ১৯৮৬ সালে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন অবৈধ সব কর্মকাণ্ডে। অবৈধ অস্ত্র, জাল নোটের কারবার ও চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী মালেক। অবৈধ টাকায় রাজধানীর তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়ায় দুটি ৭ তলা বিলাসবহুল ভবন, ধানমন্ডির হাতিরপুল এলাকায় সাড়ে ৪ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন করেছেন। দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমিতে রয়েছে একটি ডেইরি ফার্ম। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিপুল অঙ্কের অর্থ থাকার তথ্যও জানিয়েছে র্যাব। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত শনিবার গভীর রাতে কামারপাড়া বামনেরটেক ৪২ নম্বর হাজী কমপ্লেক্স ভবন থেকে আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। এ সময় তার থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৫ রাউন্ড গুলি ও দেড় লাখ টাকা মূল্যের (বাংলাদেশি) জাল নোট জব্দ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত এক যুগ ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ পদে যারা ছিলেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন চালক মালেক। নিয়োগ, কেনাকাটা ও বদলি থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক কাজে বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি করেন তিনি। এ সময় জড়িয়ে পড়েন অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার কারবারের সঙ্গে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মালেকের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অবৈধ উপায়ে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘মালেক তুরাগ এলাকায় ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অবৈধ অস্ত্র, জাল নোটের কারবার ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অবৈধ অস্ত্র, জাল নোটের কারবারসহ চাঁদাবাজি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি। গ্রেপ্তারের আগে র্যাব তার বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র, জাল নোটের কারবার ও চাঁদাবজির তথ্য পাওয়া যায়। তিনি তুরাগ এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা আদায় করতেন। তিনি স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পরিবহন পুলের একজন চালক। অনুসন্ধানে তার আয়-ব্যয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক পাওয়া যায়। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ঢাকার বিভিন্ন জায়গাতে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।’ এ র্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মালেক ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহনপুল ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত। মালেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
তদন্তের সঙ্গে জড়িত র্যাবের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, মালেক দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তরপাশে ৬ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা হাজী কমপ্লেক্স দুটি আবাসিক ভবন রয়েছে। এতে ২৪টি ফ্ল্যাট। বিল্ডিং সংলগ্ন আরও ১২ কাঠার প্লট রয়েছে। মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া ৭০ রাজাবাড়ি হোল্ডিংয়ে ১৫ কাঠার ওপর ইমন ডেইরি ফার্ম আছে। এতে ৫০টি গাভী রয়েছে। ২৩, ফ্রিস্কুল রোড, হাতিরপুলে সাড়ে ৪ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা নির্মাণাধীন ভবন। নিজের সন্তানসহ ১৫ জনকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিপ্তরের বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত মালেক। ওই সিন্ডিকেটের অনেকের শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার তথ্য রয়েছে। ড্রাইভার মালেক বিদেশে টাকা পাচার করেছেন কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।