করোনা: সচেতনতা নেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

আমসার আলী, বয়স ৩৫। এই রোহিঙ্গার কুতুপালং ৪ নম্বর ক্যাম্পে রয়েছে চায়ের দোকান। বন্ধ কুতুপালং বাজার। কিন্তু ক্যাম্পের ভিতর চালু সব।

আমসার আলী জানান, বাজার বন্ধ থাকায় বিক্রি আরও বেড়েছে। আগে সারাদিনে ২ ফ্লাক্স চা বিক্রি হতো এখন বিক্রি হয় ৫ থেকে ৬ ফ্লাক্স। কারণ হিসেবে বলেন, ক্যাম্পবাসীর কাজ নেই। পাহারার কারণে বাইরে যাওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে।

তাই চায়ের দোকানে আড্ডা বেড়েছে।

নরসুন্দর মো. ইব্রাহিম। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তিনি ঘুরে ঘুরে কাজ করেন। বিকালে ফোন দিলে তিনি বলেন, ভাই কাজ করতেছি পরে কল দিয়েন।

সন্ধ্যায় তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাথা ন্যাড়া করার ধুম পড়েছে। করোনার প্রভাবে তার ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ৪ জন নরসুন্দর একসঙ্গে কাজ করছেন। প্রশ্নের উত্তরে বলেন, করোনার হাত থেকে আল্লাহই বাঁচাইবে।

ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা। ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্টের পর উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বানের স্রোতের মত ১১লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারা এখন উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে।

সচেতনতার বালাই নেই অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের মাঝে। একটি এনজিও’র অর্থায়নে পরিচালিত রোহিঙ্গা শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই এখন কর্মহীন। আর করোনা আসার পর প্রায় সবাই বাড়িতে বসে আছেন। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গারাও ক্যাম্পে ফিরেছেন। ক্যাম্পের বাসিন্দারের মাঝে সচেতনতা নেই বললেই চলে।

এই শিক্ষক আরও বলেন, দূরত্ব বজায় রাখা, হাত পরিষ্কার রাখা, মাস্ক ব্যবহার, ঘরে থাকা ইত্যাদি সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ক্যাম্পে দূরত্ব বজায় রেখে চলা দুরহ ব্যাপার। তারপরেও নিজেদের মাঝে দুরত্ব বজায় রাখার কোন চেষ্টা নেই। আর সবার ঘরে যথেষ্ট সাবান থাকলেও হাত পরিষ্কারের বিষয়টিও গুরুত্ব দিচ্ছেন না তারা।

তারা প্রত্যেকেই জানান, খাবার কষ্ট নেই। আগের মতোই সহযোগিতা পাচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয়দের অবস্থা দিনকেদিন খারাপ হতে চলেছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর আবেদ আলীর বাস। ক্যাম্প হওয়ায় তিনি হারিয়েছেন কৃষি জমি। স্বপ্নের সংসার ভেঙ্গেছে তার৷ বাড়ির উঠানে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়ায় চলে গেছে নতুন বউ। কৃষি জমি হারিয়ে হয়ে পড়েছেন দিনমজুর। বলেন, জমিজমা হারাইলাম। মজুরি করে খাই। এখন কোন কাজ নাই। এমন খারাপ অবস্থা যে, আমার বাড়ির উঠানে যারা বাড়ি করেছে তাদের কাছে চাল ধার করে নিয়ে ভাত খেয়েছি। কাল কি খাবো জানি না।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা মিয়ানমার থেকে এসে সাহায্য পায়। তাহলে আমার অপরাধ কি? আমারতো কাজ নাই। আয় নাই। আমি কেন সাহায্য পাবো না?

পালংখালী ইউনিউয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমাদের বাঁধা দিয়ে রেখেছে প্রশাসন, তাদের কোন বাঁধা নাই। আমারা বাঙ্গালীরা অসহায় অবস্থায় দিন পারি করছি৷ সরকার ও এনজিও থেকে কিছু সহযোগিতা দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা আদরের মানুষ। তাদের কেউ বাঁধা দেয় না। ক্যাম্পের ভিতর সব সচল। আপনি ধরেন, গরুর মাংশ কিনবেন। কোথাও না পাওয়া গেলে ক্যাম্পের বাজারে পাওয়া যাবে।

করোনায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা। কক্সাবাজারেও আক্রান্ত হয়েছেন ১ জন। জেলাটি করা হয়েছে লকডাউন। চলছে শুধু অতিপ্রয়োজনীয় যানবাহন। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে ক্যাম্পেও। বাইরের লোকদের প্রবেশাধীকার সীমিত করা হয়েছে।

কুতুপালং ক্যাম্পের একজন চিকিৎসক বলেন, তাদের মাঝে সচেতনতার ছিটে ফোটাও নেই। সবসময় ভয়ে থাকি, একজনও যদি আক্রান্ত হন করোনায়, কতদ্রুত যে ছড়িয়ে পড়বে তা ভাবতেই ভয় করে।

তিনি আরও বলেন, ৩ জন রোহিঙ্গার করোনা ভাইরাস টেস্ট করবার কথা শুনেছি। করোনার সিন্ট্রোম দেখা দেয়া ব্যক্তিকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পরিবার ও আশেপাশের মানুষদের সচেতন করবার জন্য তাদের বাড়িতে যাই। কিন্তু রীতিমতো তারা বিরক্তি প্রকাশ করেন।

আবার ভয়াবহ এই পরিস্থিতির মাঝে নতুন করে দেড় শতাধিক অসুস্থ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসবার চেষ্টা করেন। ১০ই এপ্রিল শুক্রবার উখিয়া ও টেকনাফের কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দেড় শতাধিক অসুস্থ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় অবস্থান করছে বলে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান।

অসুস্থ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাত ৯ টার দিকে পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া ও হোয়াইক্যং উলুবনিয়া এলাকার মসজিদে মসজিদে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড়ের ইউপি সদস্য সুলতান আহমদ জানান, রাতে সীমান্তে দায়িত্বরত থাকা একটি সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, বেশ কিছু রোহিঙ্গা সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে এলাকার কিছু মানুষজন নিয়ে সীমান্তের পাইশাখালী নামক চিংড়ি ঘের এলাকায় পাহারা বসাই। ওপারের প্যারাবনের ভেতরে বেশকিছু মানুষের গুঞ্জন ও কান্না শোনা যায়। তবে আমরা এলাকাবাসী সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। এমনও শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও রয়েছেন।

কক্সবাজার বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ জানান, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের একটি দল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টি আমরা শুনেছি। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের পাঠানো হয়েছে। নতুন করে আর কোন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেয়া যাবেনা। সীমান্ত পাড়ি গুলোতে টহলরত বিজিবি সদস্যদের সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে।

স্থানীয় চেয়ারম্যান গফুর চৌধুরী আরও বলেন, আমার ইউনিয়ন দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকতে পারেনি। তবে ট্রানজিট পয়েন্ট ধুমধুম দিয়ে কিছু পরিবার ঢুকেছে বলে শুনেছি। তবে ঢুকেছে কীনা জানি না।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসার জন্য তারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জেনেছি।

সার্বিক বিষয়ে ইউএনও নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, চেকপোস্টগুলা আরো শক্তিশালী করা হয়েছে। ক্যাম্পে কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা প্রবেশ করে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়।

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন