মধুমাস জ্যৈষ্ঠের মিষ্টিমধু আম এবার মানুষের পাতে যাবে না গাছে পচবে-এ নিয়ে শঙ্কা এখনও কাটেনি। আমচাষি, ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, বিক্রেতা সবার চিন্তা একটাই-ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে ঠিকমতো আম পৌঁছানো যাবে তো? চাষিরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এমতাবস্থায় আমের বাজারজাতকরণ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
শনিবার (১৬ মে) এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। রাজশাহী, চাঁপাইনবানগঞ্জ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশের আম ও লিচু কীভাবে বাজারজাতকরণ করা যায় সে বিষয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আম ও লিচু ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর জন্য সর্বাত্বক চেষ্টা করা হবে।
রাজশাহীর আমবাগান মালিক ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আম বাজারে আসতে আরও এক সপ্তাহের অধিক সময় লাগবে। কারণ আম এখনও পরিপক্ক হয়নি।
চলতি মৌসুমে গাছ থেকে আম সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত দিন ছিল শুক্রবার (১৫ মে)। আমচাষিরা বলছেন, আম পরিপক্ক না হওয়ায় তারা গাছ থেকে আম সংগ্রহ করতে পারছেন না। আমের আঁটি শক্ত হতে আরও সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হবে। প্রকৃত রাজশাহীর আম বাজারে আসতে ঈদ পার হয়ে যাবে। বর্তমানের বাজারে রাজশাহীর আম বলে যে আম বিক্রি করা হচ্ছে তা রাজশাহীর আম না।
চাষি ও বাগান মালিকরা জানান, গত কয়েক বছরের টানা লোকসানে অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন। এরপরও এবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন চাষিরা। তবে করোনায় সে আশায় গুড়েবালি।
জানা গেছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে আম রফতানি নিয়ে শঙ্কায় রফতানিকারকরাও। তাদের সঙ্গে অন্তত ২০ জন আম উৎপাদনকারীর চুক্তি হয়েছে। কিন্তু করোনা সংকটের ফলে এখন রফতানিকারকরা তাদের এড়িয়ে চলছেন। অনেক চেষ্টার পরও তাদের নাগাল পাচ্ছেন না চাষিরা। ফলে আম রফতানি নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, হাওর অঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিকদের মতো আম ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের অবাধে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা এবং পরিবহনের সময় যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কোনোরূপ হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে তরমুজ চাষিরা উৎপাদিত তরমুজের অধিকাংশই বিক্রি করতে পারেননি। যা বিক্রি করেছেন তার ভালো দাম পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে আম, লিচু, আনারস ও কাঁঠালসহ মৌসুমি ফল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এসব মৌসুমি ফল সঠিকভাবে বাজারজাত না করা গেলে চাষিরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অন্যদিকে, দেশের অধিকাংশ মানুষ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মৌসুমি ফল খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। অথচ এই সময়ে করোনা মোকাবিলায় দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মৌসুমি পুষ্টিকর ফল গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক বলেন, ‘দেশে এখন নিরাপদ রফতানিযোগ্য প্রচুর আম উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। করোনার কারণে ফলের চাহিদা বাড়ায় তৈরি হয়েছে নতুন বাজার। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগোতে হবে।’
তিনি বলেন, প্রতিবার এ সময় আম রফতানিকারকরা রাজশাহীতে এসে ঘোরাফেরা করতেন। কিন্ত্র এবার এখন পর্যন্ত তাদের পদচারণা নেই। তবে করোনার কারণে আমের বিশ্ববাজার হারানোর শঙ্কা নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের দেশের বাজারও অনেক বড়। দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত আম সরবরাহ করতে পারলেই দেশের বাজারেই চাষিরা লাভবান হবেন।
আমবাজার ঘিরে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। রাজশাহীর বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. গোপেন্দ্র নাথ আচার্য বলেন, আমবাজারে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন। তাদের এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাইরে থেকে আমের মৌসুমে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা রাজশাহী অঞ্চলে আসেন। যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে আসবেন তাদের অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। তবে এখনও আমবাজার কেন্দ্রিক মেডিকেল টিম গঠন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তারাও ভাবছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষি হাসান আল সাদী পলাশ বলেন, ‘করোনার প্রভাব পরিচর্যা থেকেই শুরু হয়েছে। করোনার কারণে দেশের অন্যান্য কৃষিপণ্য যখন গড়াগড়ি খাচ্ছে তখন থেকেই আমচাষিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে বাগানের ওপর অতিরিক্ত যত্ন এবং অর্থলগ্নিকরা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকেই। আমার বাগানেও একই অবস্থা। এবার আম নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’ তিনি বলেন, এবার ঈদের পরে পাকতে শুরু করবে ল্যাংড়া এবং খিরসা। ফজলি ও আশ্বিনা আম পাকতে আরও অনেক দেরি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আড়তদার বাহরাম আলী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এবার আমরা আমের ব্যবসা করতে পারব কি-না সন্দেহ আছে। গাড়ি যদি না চলে, ব্যবসায়ীরা যদি না আসতে পারেন তাহলে তাহলে কেমন করে ব্যবসা হবে?’ তিনি বলেন, আগে প্রতিবছর ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা আসতেন। এবার এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের খবর নেই। তিনি বলেন, সরকার যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে হয়তো কৃষক, বাগানমালিক, ব্যবসায়ী সবাই বাঁচতে পারবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার বিভাগের পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, গতবারের চেয়ে এবার আম উৎপাদন বেশি হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আম উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ২৮ হাজার ৯৭২ মেট্রিক টন। এবার ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমের উৎপাদন ধরা হয়েছে ২২ লাখ ৩২ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, চাষি ও বাগানমালিকরা যাতে আম বাজারজাতকরণ করতে পারেন, সেজন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।