‘নেই নেই এবং নেই’-এর ওপর ভিত্তি করে চলছে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত দেশের প্রথম হাসপাতাল ‘কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল’। এমন চিত্র উঠে এসেছে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের ভাষ্য ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্যে। এবার অব্যবস্থাপনার বিষয়টি উঠে এসেছে হাসপাতালটিতে কর্মরত নার্সদের কথায়।
সেবাপ্রদানকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু, সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত এখনও। তারা নিজেরা সংক্রমণের ভয়ে উৎকণ্ঠিত থাকায় সঠিক ও সার্বক্ষণিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না এখানকার রোগীরা— এই অভিযোগ প্রতিদিনের।
হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের দিন পার হয় চরম প্রতিকূলতার মধ্যে। প্রয়োজনের সময় পাওয়া যায় না নার্স বা ডাক্তারদের। অভিজ্ঞ নার্সদের পরিবর্তে প্রেষণে যোগ দেওয়া নার্সদের পাঠানো হচ্ছে রোগীদের কাছে। আইসিইউ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার পরও নতুন প্রেষণে আসা নার্সদের দিয়েই চালানো হচ্ছে আইসিইউর কাজ।
এসব অব্যবস্থাপনার কথা উঠে এসেছে নতুন প্রেষণে আসা ৪১ জন নার্সের বক্তব্যে। পাশাপাশি তারা অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত নার্সিং কর্মকর্তাদের চরম দুর্ব্যবহার ও অমানবিক আচরণ নিয়ে।
এ সংকটের সমাধান চেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন সেখানে কর্মরত প্রেষণে আসা নার্সদের মধ্যে ৪১ জন।
এ নার্সরা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউট, সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ২৫০ শয্যা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসেছেন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে।
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কয়েকজন নার্সের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, সরকারি নির্দেশের কারণে তারা অফিসিয়ালি কথা বলতে রাজি হননি। তারা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী যেসব কাজ ডাক্তারের করার কথা সেগুলোও ডাক্তাররা না করে প্রেষণে আসা নার্সদের করতে বাধ্য করছেন। যেমন: রোগীর প্রেসার মাপা, প্রেসার কম-বেশি হলে নার্সরা রিপোর্ট করার পর তাদেরকেই ওষুধের নাম বলে দিয়ে আসতে বলা হয়। কোনো রোগীর শ্বাসকষ্ট হলেও নার্সদেরকে বাধ্য করা হয় ওষুধ নিয়ে তার কাছে যেতে, যেখানে ডাক্তারের যাওয়ার প্রয়োজনটাই বেশি।
এমনকি, কোনো নার্স না যেতে চাইলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। ভয় দেখানো হচ্ছে এভাবে যে, রোগী মারা গেলে দায় আপনাদের।
প্রেষণে আসা নার্সদের আবেদনের একটি কপি ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। ওই আবেদনে তারা মানসম্পন্ন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী-পিপিই বা মানসম্মত মাস্ক না পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও অভিযোগ করেছেন।
এ ছাড়াও, ইতোমধ্যে তিন জন নার্স করোনাক্রান্ত হওয়ায় সবার মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
আবেদনে তারা এসব সংকটের সমাধান চেয়েছেন। তা না হলে মানবিক বিবেচনায় তাদের প্রেষণাদেশ বাতিল করে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সেই ৪১ জন নার্স।
লিখিত আবেদনে বলা হয়েছে, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মানবসেবায় ব্রত হয়ে গত ৫ এপ্রিল তারা প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় প্রেষণে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। কিন্তু, যোগদানের পর থেকে পদে-পদে নানা বৈষম্য ও অমানবিক আচণের শিকার হচ্ছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, এই হাসপাতালে কর্মরত নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট পুরনো ৩০/৩৫ জন নার্সকে রোস্টার ডিউটি না দিয়ে দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত রাখছেন। পিপিই পরে ওয়ার্ড ও আইসিইউতে গিয়ে রোগীর সেবা করার কাজ সম্প্রতি প্রেষণে যোগ দেওয়া নার্সদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানসম্পন্ন পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক ছাড়াই নার্সদের রোগীদের সেবা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
আবেদনে নার্সরা তাদের আবাসন সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন। তাদের আবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে ঊর্ধ্বতনরাসহ সব নার্সিং কর্মকর্তা হোটেল মিলিনায় ওঠেন। কিন্তু, এরই মধ্যে এই হোটেলে অবস্থানরত তিন জন নার্স করোনাক্রান্ত হন। এরপর রাতারাতি আগে প্রেষণে থাকা ১৬ জন নার্সিং কর্মকর্তা সেখান থেকে অন্য হোটেলে চলে যান। বর্তমানে মিলিনায় নতুন প্রেষণে যাওয়া ৬৪ জন নার্সকে রাখা হয়েছে।
জায়গা না হওয়ায় দুই জনের রুমে তিন জন থাকছেন। এতে ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখার বিধান মানা হচ্ছে না। যেখানে একজন করোনাক্রান্ত রোগী ধরা পড়লে পুরো বাড়ি বা মহল্লা লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কীভাবে ৬৪ জন নার্সকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে অন্য কর্মকর্তারা চলে গেলেন, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে আবেদনে।
নার্সদের এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।