ক্রান্তিকালে তবুও সংক্রান্তি

করোনার ক্রান্তিতে পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়লেও সময় তার নিয়মে বয়ে চলছে। আজ চৈত্রের শেষ দিন। বাঙালির বহু আয়োজনের চৈত্র সংক্রান্তি আজ। স্বাভাবিক সময়ে সংক্রান্তিতে বিদায়ের সুর বাজলেও নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি থাকে তার চেয়ে শতগুণ বেশি। তাই বাংলা বছরের শেষদিনটি বেশ ধুমধাম করেই উদযাপিত হয় নগরে-বন্দরে।

তবে এবার সেটি হওয়ার জো নেই। গত ২৬ মার্চ স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া হয়নি, গত রবিবার বিশ্বজুড়ে গির্জায় গির্জায় ইস্টার সানডে পালন হয়নি। তেমনি করে সংক্রান্তি বা নববর্ষ পালনের কোনও উপায় থাকছে না এই হোম কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে।

চৈত্র সংক্রান্তির মূল আয়োজন থাকে গ্রামে। বৈশাখের মেলা চৈত্র সংক্রান্তিতেই শুরু হয়। কোথাও হয় চড়কপূজা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের নানা পাহাড়ি অঞ্চলে সংক্রান্তি উদযাপিত হয় সাড়ম্বরে। পাহাড়ে আজকের দিনেই হয় মূল উদযাপন বা বিজু। পাজন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় অতিথিদের।এবার তার কোনোটাই হচ্ছে না। করোনার ক্রান্তিতে আমরা নতুন বছরও বরণ করে নিতে পারছি না।

অথচ বরাবরই এই দিনে গ্রামে চৈত্রের শেষ দিনে চৌদ্দ রকমের শাক সংগ্রহ করে খাবার চল পালিত হয়ে আসছে। এই শাক সংগ্রহ দিয়েই নাকি প্রকৃতির গতি বোঝা যায়। সে আয়োজন হয়তো এবার হোম কোয়ারেন্টিনের ক্রান্তিতে করতে পারছি না। তবে হয়তো সনাতন ধর্ম্বাবলম্বীরা বছরের এই দিনটি ঘরেই পুজো দেবেন। যতটুকু ঘরোয়া আয়োজন করা যায়। কারণ লোকসংস্কৃতির একদল গবেষকদের মতে, চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের শাস্ত্রীয় উৎসব। ক্রমেই এ উৎসব লোকসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি পুণ্যের কাজ। প্রকৃতির হালচাল দেখেই সংক্রান্তির খাবারও নির্ধারণ হয়েছে।

যেহেতু চৈত্রমাসে আবহাওয়াতে তাপের দাবদাহই বেশি সংক্রান্তি পাতে গুরুপাক কোনও খাবার থাকে না। তিতা, শাক পাতা, ঝাল এগুলোই মূল খাবার। বসন্তের শেষ দিনের খাবার তালিকা আকর্ষণীয় করে তুলেছে- তিতকুটে পাট শাকের ঝুড়ি,কিংবা ১৪ শাক ভাজা সঙ্গে কাঁচা সরিষার ভর্তা। এদিন মূলত আমিষ বিবর্জিত। তবে চৈত্রে শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিল সেঁচে পাওয়া পাঁচ মিশালি ছোট মাছের চচ্চড়িও চলে কোথাও কোথাও। তবে পাহাড়ি আর লোকশাস্ত্র মেনে চলা মানুষগুলো এদিন একেবারেই মাছ-মাংস ঢুকতে দেন না বাড়িতে।

লোকসংস্কৃতির গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন,চৈতি সংক্রান্তিকে কোনও ধর্মীয় শাস্ত্রে বা আবহে বেধে ফেলার উপায় নেই।এটি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অংশ। দীর্ঘদিন ধরে ঋতুর ওপর নির্ভর করে আমাদের খাদ্য সংস্কৃতি নির্ধারিত হয়েছে। যেহেতু উৎসব মানেই খাবারের আধিক্য এখানেও তার কমতি নেই। তবে শেষদিনটি চৈত্রের রোগবালাই দূর করতে তিতাতেই শেষ হয়। নানা রকম শাক, সবজি থাকে এই তালিকায়। আর চৈত্রের শেষ দিন বাড়িতে থাকা গাছ থেকে অনেকেই আম সংগ্রহ রাখেন। বছরের প্রথম দিন সেটি ডাল দিয়ে রান্না করে কিংবা টক বানিয়ে খাওয়ার চল আছে। বছরের শেষদিনে তিতা আর শুরুর দিনে টক খেলে রোগমুক্তি ঘটবে এ বিশ্বাস ঘরে ঘরে।

পাহাড়ে বিজুর আয়োজনে থাকে হরেক রকম সবজির মিশ্রণে তৈরি করা পাজন। হরেক রকমের সবজির মিশ্রণে রান্না হয় এই পাজন বা পাজোন। পাজন শব্দটি মূলত চাকমা নৃগোষ্ঠীর। ৩০-৩২ রকমের ভিন্ন সবজি দিয়ে পাজন রান্নার চেষ্টা চলে। এই দিনে কমপক্ষে সাত বাড়িতে খাওয়ার প্রচলন আছে। চাকমাদের বিশ্বাস, এতে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

অন্যদিকে ত্রিপুরাদের কাছে এই খাবারটি পাচন নামে পরিচিত। একসময় তারা ১০৮ রকম সবজি দিয়ে খাবারটি রান্না করতো। সবজির এই মিশ্রণকে তারা ঔষধি মনে করেন। যদিও এখন সব ধরনের সবজি সংগ্রহ করা কঠিন। তাই হাতের নাগালে যা পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েই রান্না হয় পাচন।

তবে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও আঁচ এসেছে সংক্রান্তি পালনের। ছোটখাটো মেলা বসে শহরের আশপাশে।শহরের মাঝেও ইদানিং বড় বড় মঙ্গলশোভাযাত্রা শুরুর আগে থেকেই চারুকলা ইনস্টিটিউটে দিন-রাত একাকার করে পালিত হয় সংক্রান্তি। মূলত এরা বর্ষবরণের প্রস্তুতি আর

সাইমন জাকারিয়া আরও জানান, এবার তো কোনও উৎসবই পালিত হচ্ছে না। দেশের নানা স্থানের লোকশিল্পীরা ঢাকায় বা তার আসেপাশে এসে ঢাকায় এসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন, তাদের প্রস্তুতি থাকলেও তারা কোথাও যাচ্ছেন না। তাই কোথাও আয়োজিত হচ্ছে না মুখোশে ঢাকা হরগৌড়ি নাচ, বাইদান নাচের পালা।

তবু বসন্ত শেষ নতুন বছর আসছে সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

করোনার ক্রান্তিতে পাহাড়ে উদযাপিত হয়নি ফুল বিজু, তাই ঢাকায় ঘরবন্দি অবস্থায় ফুলবিজু স্মরণে আয়োজন করেছেন সিএইচটি এক্সপ্রেসের শেফ ও কর্ণধার অর্পণ চাকমা

মন্তব্য করুনঃ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন