দিল্লির নিজামুদ্দিন তাবলিগ মারকাজ এখন ভারতের প্রায় সব মিডিয়ার প্রধান খবর। কয়েক দিন ধরে তাবলিগ মারকাজের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বক্তব্য প্রচার করে সমালোচনা করা হচ্ছে ভারতের প্রথম সারির টিভি চ্যানেলগুলোয়।
মাওলানা সাদ তার বক্তব্যে বলেছেন, কোনো ডাক্তার যদি মসজিদে আসতে বারণ করে, আর বলেন– অসুস্থ মানুষের সঙ্গে মিশলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা হলে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষকে মসজিদ থেকে দূরে রাখা কোনোক্রমেই ভালো কাজ হবে না।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালও সাংবাদিকদের সামনে মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছেন। দিল্লি নিজামুদ্দিনের মাওলানা কেন এমন বক্তব্য দিলেন তা নিয়ে হইচই।
অথচ এখানে ভারত সরকারের গাফিলতিই দায়ী এই পুরো ঘটনার জন্য। খোদ মাওলানা সাদ বলছেন, হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করায় পূর্বনির্ধারিত ইজতেমায় আসা মানুষগুলো আটকা পড়েন নিজামুদ্দিন মারকাজে।
প্রশাসনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও আটকেপড়া মানুষগুলোকে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারেনি দিল্লি প্রশাসন। বাস, ট্রেন ও গাড়ি ঘোড়া– সব কিছুই বন্ধ এতদিন ধরে। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি সাধারণ আটকেপড়া মানুষের জন্য।
দিল্লি সরকারের ব্যর্থতার দায় ঢাকতে এখন প্রচার করা হচ্ছে মাওলানা সাদের দুই সপ্তাহ আগের একটি অডিও বক্তব্য।
মূলত করোনাভাইরাসের মতো মহামারী পৃথিবীতে অভিনব একটি বিষয়। প্রতি শতাব্দীতে একবার মহামারী দেখা দেয়। আর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী এর আগে পৃথিবীতে একবারই এসেছিল।
সেই ৭৪৯ হিজরি সনে। কালো মড়ক নামে যা বিখ্যাত। এ জন্য এ বিষয়ে সব শ্রেণির মানুষের মাঝেই চর্চার ঘাটতি থাকে। এ সংক্রান্ত তথ্যাদি কারোরই নখদর্পণে থাকে না।
মাওলানা সাদ একা নন। মহামারী সম্পর্কে সবচেয়ে অথেন্টিক গ্রন্থ লিখেছেন হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)। তিনিও একই ভুলের স্বীকার হয়েছেন তার বাজলুল মাউন গ্রন্থে। তাদের এ ভুল আমাদের অবশ্যই মার্জনা করতে হবে।
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তার গ্রন্থের ৩৪১ নং পৃষ্ঠায় লিখেন– ‘চিকিৎসকরা মহামারীর সময়ে অসুস্থদের সংস্পর্শে আসতে বারণ করেন। তাজুদ্দিন সুবকি বলেন, সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের সময়ের মহামারীতে দেখেছি চিকিৎসকদের এ পরামর্শ অনুসারে অসুস্থদের থেকে দূরে থাকছে। এমনকি রোগীর শুশ্রুষা থেকেও তারা বিরত থাকছেন।
সুবকি বলেন, আমার মত হচ্ছে– যদি দক্ষ চিকিৎসকরা এমনটি বলে থাকেন, তা হলে মেনে নেয়াই উচিত।’
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাজুদ্দিন সুবকির অভিমত খণ্ডন করে লিখেন– আমি বলব, মুসলিম দক্ষ দ্বীনদার চিকিৎসকও এমন সংক্রমণের কথা বললে তার কথাও গ্রহণযোগ্য হবে না।
মিসর ও সিরিয়ায় কতবারই তো মহামারী হলো। প্রতিটি ঘরেই মহামারী ঢুকেছে। ঘরের মানুষের সঙ্গে অসুস্থ লোকদের তো মিশতেই হয়েছে। অন্য অসুস্থ লোকের সঙ্গে মেশা যা, ঘরের অসুস্থদের সঙ্গে মেশাও সমপর্যায়ের।
যদি রোগীর সংস্পর্শের কারণেই রোগ সংক্রামিত হতো তা হলে এসব অঞ্চলের কোনো লোকই বাঁচতে পারত না। কাজেই কোনো চিকিৎসক এ ধরনের পরামর্শ দিলে তা হঠকারিতা ছাড়া কিছুই নয়। চিকিৎসকদের কথা কোনোভাবেই মানা ঠিক হবে না।
সংক্রমণের বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি। তাজুদ্দিন সুবকির ওপর আল্লাহ রহম করুন, তিনি হাদিসের অন্য ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি প্রকৃতিবাদীদের মতো কথা বলেছেন। মুতাজিলারাও এ ধরনের কথা বলেছেন।’ ইবনে হাজারের কথা শেষ হলো।
মূলত বুখারি শরিফের একটি বর্ণনা রয়েছে, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, সংক্রমণ বলে কিছু নেই। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় খোদ হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারী গ্রন্থে বহু অভিমত তুলে ধরেছেন।
ইবনুস সালাহ ও ইবনে হাজার প্রমুখের মতে, এর অর্থ হচ্ছে– সংক্রমণের কোনো অস্তিত্ত্ব নেই ইসলামে। এটিকে আকিদার বিষয় বানিয়ে দিয়েছেন তারা।
অথচ এ হাদিসের শেষ অংশে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন করো সিংহ দেখে যেভাবে পালিয়ে থাক।
কথা হচ্ছে– যদি সংক্রমণকে অস্বীকার করাই নবীজির উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে রাসুল (সা.) একই হাদিসে সংক্রমণের ধারণাকে সমর্থন করে এমন তাগিদ দিয়ে কথা বললেন কেন?
এর উত্তর দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে হাফেজ ইবনে হাজার ও তার অনুসারীদের।
ইমাম বুখারির সমসাময়িক বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত ইবনে কুতায়বা দিনুরি (রহ.)। তিনি পরস্পরবিরোধী হাদিসসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করে একটি কিতাব লিখেছেন। মুখতালাফুল হাদিস। সেখানে এ হাদিসের দুই অংশের মাঝে সমন্বয় করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা খুবই বিজ্ঞান সম্মত।
তিনি বলেন, মূলত নবীজি জাহিলি যুগের কুসংস্কার রদ করেছেন। জাহিলি যুগে কেউ অসুস্থ হলে অন্যরা তার কাছে ভিড়ত না। তারা মনে করত যে কোনো রুগ্ন ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেই সংক্রমিত হয়ে পড়বে।
এ ধারণাটি নবীজি দূর করতে গিয়ে বলেন, ‘লা আদওয়া’ অসুস্থ ব্যক্তির কাছে গেলেই রোগ ছড়ায় না। সঙ্গে সঙ্গে রাসুল (সা.) ভাইরাসজনিত রোগ থেকে সতর্ক করেন।
কারণ কিছু রোগ আছে, যা ছোট্ট জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায়। এ ধরনের রোগে যারা আক্রান্ত, তাদের থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।
কিছু কিছু ভাইরাস আছে, যা আগুনের মতো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারও হাতে কাষ্ঠখণ্ড আগুন থাকলে যেমন তার থেকে সতর্ক থাকতে হয়, তেমনিভাবে কারও ভেতর ভাইরাস বাসা বাঁধলে তার থেকেও সতর্ক সাবধান থাকা নবীজির নির্দেশ।
করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে মূলত এর ধরন সম্পর্কে আলেম উলামা ও সাধারণ মানুষ ধারণা করে উঠতে পারেননি।
এখনও সাধারণ মানুষ সচেতন হতে পারছে না। কারণ তাদের এ বিষয়ে কোনো পূর্ব ধারণা নেই।
একটি দেশের সরকারের এমন সময়ে কর্তব্য থাকে জনগণকে সতর্ক করা। এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বক মানুষকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করানো।
দিল্লির মাওলানা সাদ তাবলিগের মানুষ। তার ভুল হতে পারে। হতে পারে অসতর্কতা। কিন্তু এখানে দিল্লি প্রশাসন এটিকে মুসলমানদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তাবলিগ দ্বন্দ্বের জেরে ভারতের সাদবিরোধী শিবিরকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তারা ইচ্ছে করলে এটি সাদের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন।
কিন্তু তারা এমন ভুল করেননি। সাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডায় অংশ নেননি। বরং তার পক্ষে বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। মূলত এ ধরনের পরিস্থিতিতে কে কি ভুল করল তা গবেষণা করে বেড়ানো খুবই জঘন্য একটি বিষয়।
হাদিসে আছে আল্লাহর আজাব যখন আসে, তখন যদি পারস্পরিক সৌহার্দ ও ভালোবাসা বাড়ানো হয় তা হলে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আজাব-গজব উঠিয়ে নেন।
কাজেই হাফেজ ইবনে হাজার বা মাওলানা সাদের ভুল ধরে কাজ নেই। আসুন আমরা সবাইকে সচেতন করি। এখনও আমাদের মসজিদগুলোতে জমায়েত বন্ধ হয়নি। অসতর্কভাবে আমরা সবখানেই চলাফেরা করছি।
সরকার বা শরিয়তের নির্দেশনা মানার কোনো লক্ষণ আমাদের ভেতর দেখা যাচ্ছে না। বিপদে পড়ে আমরা অতিআবেগী হয়ে মসজিদে ছুটছি। আবার এই আমরাই আল্লাহ না করুন মসজিদ ভেঙে ফেলতেও হয়তো দেরি করব না।
আবেগী মানুষের আবেগ উল্টে যেতে সময় লাগে না। সচেতন বিদগ্ধ আলেম-উলামা লকডাউনে আটকেপড়া মানুষের মসজিদমুখী হতে দেখে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। মোটেও ভালো লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করছেন না জুমা ও জামাতে সব মানুষের ভিড়কে।
যখন মসজিদে যাওয়ার দরকার ছিল, তখন মসজিদ থেকে দূরে থাকত এখন যখন মসজিদে না গিয়ে ঘরে নামাজ পড়ার কথা আসছে, তখন সব ভিড় করছে মসজিদে।
প্রতি ওয়াক্তে শবেবরাতের মতো উৎসবমুখর পরিবেশ মহল্লার মসজিদগুলোয়। আল্লাহ তুমি সবাইকে বুঝ দাও। আমিন।